সেবাবঞ্চিত নগরবাসী
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন চলছে জোড়াতালি দিয়ে

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন চলছে অর্ধেক শক্তিতে। একদিকে পদ শূন্য, অন্যদিকে অতিরিক্ত দায়িত্বে ক্লান্ত কর্মকর্তারা। দুই কোটি মানুষের এ নগরে নিত্যদিনের সেবা দিতে গিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে প্রশাসন। নাগরিকরা প্রত্যাশিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, আর কর্মকর্তারা জোড়াতালি দিয়ে চালাচ্ছেন করপোরেশনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির রাজস্ব খাতে অনুমোদিত ৩ হাজার ১৬৬ পদের মধ্যে ১ হাজার ৩০৭টি শূন্য। অন্যদিকে, উত্তর সিটির ২ হাজার ৬৮০ পদের মধ্যে খালি ৯১৫টি। দীর্ঘদিন ধরে নিয়োগ না হওয়ায় একজন কর্মকর্তাকে একসঙ্গে দুই-তিনটি দপ্তরের দায়িত্ব সামলাতে হচ্ছে। আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাদের অবস্থাও একই—একজনের কাঁধে একাধিক জোনের দায়িত্ব। সংস্থা দুটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যে স্পষ্ট, জনবল সংকট বেশ প্রকট।
দক্ষিণ সিটির ১০ অঞ্চলের দায়িত্বে রয়েছেন মাত্র পাঁচ কর্মকর্তা। এর মধ্যে দুজন সামলাচ্ছেন ছয়টি অঞ্চল, বাকি তিন কর্মকর্তার কাঁধে চারটি অঞ্চলের দায়িত্ব। শূন্য রয়েছে প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা ও নিরীক্ষা কর্মকর্তার পদ। কেন্দ্রীয় হিসাব বিভাগের প্রধানের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন উপপ্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. আলী মনসুর। বিদ্যুৎ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীর অধীনে দুটি উপসহকারী প্রকৌশলীর পদ খালি। যান্ত্রিক বিভাগের সহকারী প্রকৌশলীর পদ শূন্য, কাউকেই অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পুর), পরিবেশ, জলবায়ু ও দুর্যোগ শাখার পদও দীর্ঘদিন ধরে ফাঁকা।
স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার দায়িত্বেও রয়েছে দুই সিটি। কিন্তু এ খাতও অবহেলিত। দক্ষিণ সিটির স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. নিশাত পারভীন সামলাচ্ছেন স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব। উপপ্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তার পদ শূন্য। দক্ষিণ সিটির তত্ত্বাবধানে থাকা তিনটি হাসপাতালের অবস্থাও নাজুক; জনবল সংকটে ধুঁকছে চিকিৎসাকেন্দ্রগুলো।
স্বাস্থ্য বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি অংশ ভেটেরিনারি বিভাগে ১০ জনের মধ্যে আছেন মাত্র চার কর্মকর্তা। পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় দক্ষিণ সিটির ১০টি অঞ্চলের সব বাজার পর্যবেক্ষণ সম্ভব হচ্ছে না। আধুনিক খাদ্য পরীক্ষাগারের জনস্বাস্থ্য অ্যানালিস্ট পদও শূন্য; একজন রসায়নবিদ অতিরিক্ত দায়িত্বে কাজ চালাচ্ছেন। এ ছাড়া ভান্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তার পদ খালি। সম্পত্তি বিভাগের প্রধানসহ চারটি পদ ফাঁকা। প্রটোকল দপ্তরে কোনো কর্মকর্তা নেই। সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন বিভাগের চারটি পদের মধ্যে দুটি শূন্য। নগর পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্বে আছেন স্থপতি সিরাজুল ইসলাম। ফাঁকা রয়েছে ভূগোলবিদের পদ। দীর্ঘদিন ধরে খালি আইসিটি সেলের প্রোগ্রামার পদও।
গত ২০ আগস্ট দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সচিব মুহাম্মদ শফিকুল ইসলামের স্বাক্ষরিত এক আদেশে দেখা যায়, অঞ্চল-৩ ও ৭-এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তার পদ শূন্য থাকায় অঞ্চল-৬-এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সুজাউদ্দৌলাকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
এদিকে উত্তর সিটি করপোরেশনে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন সচিব মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান। সংস্থাপন শাখা-১ ও ২-এর সহকারী সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন রাজস্ব বিভাগের অঞ্চল-৪-এর উপকর কর্মকর্তা আব্দুল খালেক মজুমদার। সাধারণ প্রশাসনের সহকারী সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন অঞ্চল-৫-এর উপকর কর্মকর্তা মোহাম্মদ দ্বীন ইসলাম। পরিবহন শাখার মহাব্যবস্থাপক হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্বে আছেন মোহাম্মদ শওকত ওসমান, যিনি একই সঙ্গে প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তার দায়িত্বও সামলাচ্ছেন। এ বিভাগের বাকি দপ্তরগুলো সামলাচ্ছেন মহাখালী বাস টার্মিনালের সহকারী ব্যবস্থাপক মেহেদী হাসান।
প্রকৌশল বিভাগেও একই চিত্র। সিভিল সার্কেলের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ফারুক হাসান মো. আল মাসুদ একই সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পুর) ও ড্রেনেজ সার্কেলের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। বিদ্যুৎ বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী মো. সাইফুল ইসলাম সামলাচ্ছেন নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্ব। প্রধান প্রকৌশলীর স্টাফ অফিসার কামরুল হাসান পালন করছেন ড্রেনেজ সার্কেলের নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্ব। এ বিভাগের আরও কয়েকজন সহকারী প্রকৌশলী একাধিক দায়িত্ব পালন করছেন।
ডিএনসিসির আইসিটি সেলের অবস্থাও একই। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর দায়িত্ব পালন করছেন এস এম শফিকুর রহমান। একই সঙ্গে তিনি প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদেরও অতিরিক্ত দায়িত্বে আছেন, যদিও তার মূল পদ নগর পরিকল্পনা বিভাগের স্থপতি। এ বিভাগের ১২টি পদের মধ্যে ছয়টি চলছে অতিরিক্ত বা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মাধ্যমে।
ভান্ডার ও ক্রয় বিভাগের ভান্ডার এবং ক্রয় কর্মকর্তা হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন সহকারী প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মো. আরাফাত হোসেন। রাজস্ব বিভাগের পাঁচটি পদ সামলাচ্ছেন মাত্র তিন কর্মকর্তা। এর মধ্যে প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ মামুন মিয়া প্রশাসকের একান্ত সচিব হিসেবেও অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন বিভাগ ও দপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ পদে একই ব্যক্তি একাধিক দায়িত্ব পালন করছেন।
জনবল সংকট সমাধানে দক্ষিণ সিটি চলতি মাসে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করবে বলে জানিয়েছেন সংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জহিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘দ্রুততম সময়ের মধ্যে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে শূন্যপদগুলোতে নিয়োগ দেওয়া হবে। এ মাসের মধ্যে স্বাস্থ্য বিভাগের জন্য ডাক্তার ও প্রকৌশলী বিভাগের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে। বাকি পদগুলোতে পর্যায়ক্রমে নিয়োগ দেওয়া হবে। অল্প সময়ের মধ্যে জনবল সংকটের বিষয়টি সমাধান হবে।’
উত্তর সিটিতে এরই মধ্যে দুই দফা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ। তিনি বলেন, ‘সামনে নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়া হবে। বাকি পদগুলো পূরণে আরও বেশকিছু সার্কুলার দেওয়া হবে।’ সৌজন্যে: কালবেলা