যে টিকটকারের যন্ত্রণায় আত্মঘাতী হতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশি নারী
এক টিকটকারের লাগাতার ধর্ষণের হুমকি, অনলাইন ট্রলে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হতে হতে আত্মহত্যার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন যুক্তরাজ্যে বসবাসরত এক বাংলাদেশি নারী। তাকে ‘অনলাইন লক্ষ্যবস্তু’তে পরিণত করার অভিযোগ যে টিকটকারের বিরুদ্ধে উঠেছে—তিনিও বাংলাদেশের নাগরিক, থাকেন প্যারিসে।
অনলাইন ট্রলিংয়ের শিকার ওই নারীর নাম সুলতানা (ছদ্মনাম)। যুক্তরাজ্যের ইয়র্কশায়ার জেলার বাসিন্দা সুলতানা বিবিসিকে বলেন, ‘আমার মনে হচ্ছিল আমার মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়েছে। আমি প্রতিদিন কাঁদতাম; খেতে পারতাম না, ঘুমাতে পারতাম না।’
‘একটা পর্যায়ে আমার মনে হতো যে প্রতিদিন এই যন্ত্রণা সহ্য করার চাইতে মরে যাওয়া ভাল। আমি আত্মহত্যার কথাও চিন্তা করেছিলাম।’
সুলতানা নিজেও নিয়মিত টিকটক ব্যবহার করেন। সেখানে নারী প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব, ভালবাসার সঙ্গীর হাতে নির্যাতন প্রভৃতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন কন্টেন্ট নিয়মিত নিজের টিকটক অ্যাকাউন্টে পোস্ট করতেন তিনি। ২০২১ সালে নিজের এক বন্ধুকে অনলাইন ট্রল ও বুলিং থেকে বাঁচাতে গিয়ে হাসান সাঈদ নামের প্যারিস নিবাসী ওই বাংলাদেশি টিকটকারের ‘টার্গেটে’ পড়েন তিনি।
তখন থেকে হাসান সাঈদ নিয়মিত সুলতানাকে লক্ষ্য করে বিদ্রুপ, ঘৃণা ও হুমকিমূলক বিভিন্ন কন্টেন্ট পোস্ট করতে থাকেন। তারপর টানা দুই বছর এই যন্ত্রণা সুলতানাকে সহ্য করতে।
‘এই দুই বছর আমার ওপর দিয়ে কী গেছে, তা বলে বোঝাতে পারব না। আমাকে লক্ষ্য করে পোস্ট করা বিভিন্ন কমেন্টে লোকজন হাসাহাসি করত, উসকানিমূলক মন্তব্য ছড়াতো। আমি প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে থাকতাম এবং এক পর্যায়ে মানসিক চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয় আমাকে। এখনও আমি পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারের (পিটিএসডি) মধ্যে রয়েছি।’
যুক্তরাজ্যে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কমিউনিটির অধিকাংশ লোকজন ধর্মীয়ভাবে রক্ষণশীল। তবে সেখাকার নারীদের মধ্যে টিকটক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বেশ জনপ্রিয়। কারণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হলো তাদের কাছে এমন একটি প্ল্যাটফরম যেখানে তারা মন খুলে বিভিন্ন ইস্যুতে কথা বলতে পারেন, পছন্দসই কন্টেন্ট শেয়ার করতে পারেন।
আর প্যারিসপ্রবাসী টিকটকার হাসান সাঈদও তার বিদ্বেষমূলক নানা কন্টেন্টের ক্ষেত্রে লক্ষ্যবস্তু বানান ব্রিটেনের বাংলাদেশি কমিউনিটির লোকজনকেই। কারণ ফ্রান্সের কাউকে তিনি লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছেন— এমন তথ্য পায়নি বিবিসি।
তবে প্যারিসের শহরতলি অঞ্চলে বসবাসকারী হাসান সাঈদের টিকটক অ্যাকাউন্টের ফলোয়ারের সংখ্যা হাজার হাজার।
টিকটকার হাসানের ট্রলিং বা বুলিংয়ের ধরন হলো— তিনি যাদের ‘টার্গেট’ করেন, প্রথমে ফেসবুক,ইন্সটাগ্রাম ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে তাদের ছবি ও ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করেন। তারপর সেসব ব্যবহার করে ভিকটিমদের বিরুদ্ধে উসকানি-ঘৃণা-বিদ্বেষমূলক ভিডিও বানান।
হাসানের আরেক শিকারের নাম মাসুমা। স্বামীর সঙ্গে ওয়েলসে বসবাসকারী মাসুমা বর্তমানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন। টিকটকে নিয়মিত বিভিন্ন খাবারের রেসিপি শেয়ার করেন তিনি। এছাড়া তার নিজের একটি ছোটো দোকান রয়েছে। সেই ব্যবসাও তিনি পরিচালনা করেন টিকটকের মাধ্যমে।
২০২২ সালের কোনো এক দিন টিকটকে নিজের রান্নার একটি ভিডিও লাইভ করার সময় হাসান কমেন্ট বক্সে বলেন, তিনি মাসুমার ভিডিও কন্টেন্টে অতিথি হিসেবে আসতে চান এবং কবে তার এই চাওয়া পূর্ণ হবে। মাসুমা তার এই ‘চাওয়াকে’ প্রত্যাখ্যান করলে হাসান মাসুমাকে ‘ঝুলিয়ে দেওয়ার’ হুমকি দেন।
তার কিছুদিন পরই একটি কন্টেন্ট টিকটকে ঘুরে বেড়াতে দেখেন মাসুমা, যেখানে তার ছবি ও ঠিকানা ব্যবহার করে বলা হয়েছে— মাসুমা একজন যৌনকর্মী। তিনি টিকটকে রিপোর্ট করার পর যদিও সেই ভিডিও নামিয়ে ফেলা হয়েছে, তবে এই ভিডিওর কারণে মাসুমাকে ব্যাপক ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হয়েছে যার জের এখনও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে তাকে।
‘ভিডিও ডিলিটের পরও অনেক দিন আমার ফোনে অপরিচিত বিভিন্ন নাম্বার থেকে ফোন আসত এবং সেসব ফোনে অশ্লীল প্রস্তাব-হুমকি দেওয়া হতো। এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে আমার সব ছবি মুছে ফেলতে হয়েছে, ফোন নম্বর বদলাতে হয়েছে এবং দীর্ঘদিন টিকটক ব্যবহার বন্ধ রাখতে হয়েছে। এখন যদিও আমি ভিডিও শেয়ার করি, তবে আগের তুলনায় অনেক কম।’
তিনি আরও জানান, হাসানের বিরুদ্ধে ওয়েলস পুলিশের কাছে অভিযোগ জানিয়েও হতাশ হয়েছেন। কারণ, পুলিশ তার অভিযোগ কানে তোলেনি।
যেভাবে ফাঁসলেন হাসান
তবে টিকটকার হাসান যে কেবলই যে বাংলাদেশি নারীদের লক্ষ্যবস্তু বানান— এমন নয়। কামরুল ইসলাম নামের এক যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাংলাদেশিও ব্যাপক হয়রানির শিকার হয়েছেন তার কারণে। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে টিকটকে নিজের স্ত্রীর ছবি সম্বলিত একটি সংক্ষিপ্ত ভিডিও ঘুরে বেড়াতে দেখেন কামরুল। সেই ভিডিওতে তার স্ত্রী রুখতানকে ‘পেশাদার যৌনকর্মী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
নিজের স্ত্রীর এমন আপত্তিকর ভুয়া ভিডিও দেখে হতভম্ব হয়ে পড়েন স্ত্রী-দুই সন্তান নিয়ে ইংল্যান্ডের স্ট্যাফোর্ডশায়ারে বসবাসকারী কামরুল। অনলাইনে হাসান সাঈদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এসব ভিডিও সরিয়ে দিতে বলেন তিনি।
কিন্তু তাতে ফলাফল হয় উল্টো। হাসান এবং তার ফলোয়াররা কামরুল এবং তার পরিবারের সদস্যদের লক্ষ্য করে একের পর এক অশ্লীল- অপমানজনক কন্টেন্ট শেয়ার করা শুরু করেন টিকটকে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার কামরুল ও তার সন্তানদের হত্যা এবং তার স্ত্রী রুখতান ইসলামকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয়েছে।
‘প্রথমে আমি ব্যাপারটিকে গুরুত্ব দিই নি। কিন্তু বাংলাদেশি কমিউনিটির অন্যান্যদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, হাসান গত কয়েক বছর ধরে যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাংলাদেশিদের নানাভাবে হয়রানি করছে।’
‘যখন এসব ঘটছে, আমার স্ত্রী তখন সাত মাসের গর্ভকালীণ অবস্থায়। আমার বড় সন্তান স্কুলে যায়। আমি প্রতিদিন তাকে স্কুলে পৌঁছে দিই। সারক্ষণ আমার মধ্যে ভয় কাজ করত— যদি আমার অনুপস্থিতিতে আমার স্ত্রী-সন্তানের ওপর হামলা হয়, তখন কী হবে? এই ভীতির কারণও ছিল। যুক্তরাজ্য ও ইংল্যান্ডে হাসানের প্রচুর ফলোয়ার রয়েছে।’
এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে টিকটক কর্তৃপক্ষকে হাসানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে মেইল করেন তিনি। পাল্টা মেইলে টিকটক কর্তৃপক্ষ জানায়, হাসান সাঈদ টিকটকের কমিউনিটি গাইডলাইন ভঙ্গ করার মতো কিছু করেননি।
বিবিসিকে কামরুল জানান, টিকটকের মেইল পাওয়ার পর থেকে দুশ্চিন্তা ও ভীতিজনিত কারণে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। উপায় না দেখে প্যারিসে ব্রিটেনের দূতাবাসের মাধ্যমে ইংরেজি জানেন এমন একজন আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করেন।
সেই অনুরোধে সাড়া দিয়ে ম্যাথিউ ক্রোইজেট নামের এক আইনজীবীর সঙ্গে কামরুলের যোগাযোগ করিয়ে দেয় ব্রিটেনের দূতাবাস। ক্রোইজেটের সঙ্গে প্রাথমিক আলাপ-আলোচনার পর প্যারিসের একটি আদালতে হাসান সাঈদের বিরুদ্ধে মামলা করেন কামরুল ইসলাম।
কিন্তু সেই মামলাতেও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হচ্ছিল না। কামরুলের আইনজীবী ক্রোইজেট তাকে জানান, কয়েকটি কারণে মামলার কার্যক্রম এগোচ্ছে না। প্রথমত, যেসব পোস্টকে আপত্তিকর বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে— ফ্রান্সের প্রচলিত আইন ও সংস্কৃতিতে তা আপত্তিকর নয়। কেউ যদি হামলা না করে কেবল হুমকি দেয়— তাহলে তাকে বড় অপরাধ বলে মনে করে না ফ্রান্সের আইন।
দ্বিতীয়ত, ফ্রান্সের বিচার ব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। প্রয়োজনের তুলনায় দেশটির বিচারকের সংখ্যা কম। তৃতীয়ত ফ্রান্সে ইসলামভীতি দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে এবং যেহেতু কামরুলের নামের সঙ্গে ‘ইসলাম’ রয়েছে, ফ্রান্সের বর্তমান পরিস্থিতিতে তার জন্য ন্যায়বিচার পাওয়া কঠিন।
এদিকে কামরুল যখন প্যারিসের আদালতে মামলার ব্যস্ততার মধ্যে ছিলেন, তখনও নিয়মিত তিনি ও তার পরিবারের সদস্যদের লক্ষ্য করে ঘৃণা ও উসকানিমূলক ভিডিও টিকটক, ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করছিলেন তিনি।
হাল না ছাড়া কামরুল ইসলাম শেষ চেষ্টা হিসেবে ব্রিটেনের পার্লামেন্টের অধীন নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইনফরমেশন কমিশনার অফিসে (আইসিও) যোগাযোগ করে নিজের অভিযোগ জানান। সেই সঙ্গে টিকটক ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপলোড করা আপত্তিকর ভিডিও গুলোর লিংকও শেয়ার করেন তিনি।
আইসিওতে অভিযোগ দেওয়ার পর কাজ হয়। ভিডিওগুলো দেখার পর আইসিও কর্মকর্তারা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। সেই সঙ্গে ভিডিওগুলো মুছে ফেলা এবং হাসান সাঈদের যাবতীয় আইডি অকার্যকর করতে টিকটক, ফেসবুক এবং ইউটিউবকে ৭ দিন সময় দেন।
এবং সাত দিন পার হওয়ার আগেই বিবৃতি জারির মাধ্যমে এই তিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম জানায় হাসান সাঈদের যাবতীয় ভিডিও, পোস্ট ও কন্টেন্ট মুছে ফেলা হয়েছে এবং যেসব আইডি তিনি চালাতেন, সবগুলো ব্লক করে দেওয়া হয়েছে।
বিবিসিকে কামরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের এখানকার কমিউনিটি রক্ষণশীল। এখানে সামাজিক সম্মান রক্ষায় নারী নিপীড়ন, নির্যাতন এমনকে অনেক সময় ধর্ষণের মতো বড় অপরাধও চেপে যাওয়া হয়; আর হাসানের মতো দানবরা এই অবস্থার সুযোগ নেয়।’
‘আমি যুক্তরাজ্যে নিবাসী আমার সকল বোনকে অনুরোধ করে বলতে চাই, আপনার চুপ থাকবেন না। ঐক্যবদ্ধ হোন, আওয়াজ তুলুন। আপনারা যদি চুপ থাকেন, তাহলে হাসানের মতো অপরাধীরা আস্কারা পাবে এবং বার বার এ ধরনের অপরাধ ঘটাতে থাকবে।
হাসান সাঈদের বক্তব্য জানার জন্য ফোন নম্বর জোগাড় করে তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল বিবিসি, কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি। সূত্র : বিবিসি