জলাবদ্ধতা আর পাহাড়ি ঢলে হাওরে বাড়ছে উৎকণ্ঠা
মৌসুমের দিনক্ষণ যতই ঘনিয়ে আসছে পাহাড়ি ঢল আর প্রাকৃতিক বৈরিতা উৎকণ্ঠা বাড়িয়ে তুলছে হাওর পাড়ের কৃষকদের মধ্যে। সুনামগঞ্জ জেলার বিভিন্ন হাওরে আগাম জাতের ধান কাটা শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে আর সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে পুরো দমে ধান কাটা শুরু হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে বৃষ্টিতে বাড়ছে সুনামগঞ্জের সব নদ-নদীর পানি। উজান থেকে আসা পানি নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে ফসল রক্ষা বাঁধে চাপ সৃষ্টি করছে। অনেক নড়বড়ে বাঁধে মাটি ধসে ভাঙনের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। বৃষ্টির পানিতে নিচু হাওরে জলাবদ্ধতায় আক্রান্ত হয়েছে বোরো ফসল। এ নিয়ে কৃষকের মধ্যে উৎকন্ঠা বাড়ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টানা বৃষ্টিতে জেলার সদর উপজেলার জাউয়ার হাওর, শিয়ালমারা হাওর, দেখার হাওরের কিছু নিচু এলাকা এবং শান্তিগঞ্জ উপজেলার পাখিমারা, জামখলার হাওরসহ জেলার বিভিন্ন হাওরে অন্তত হাজার হেক্টর জমির ফসল আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এতে ফসলের সুরক্ষা নিয়ে শঙ্কিত সংশ্লিষ্ট হাওরের কৃষক। এছাড়াও পাহাড়ি ঢলে নদীর পানি বেড়ে তাহিরপুর উপজেলার কৃষকদের উদ্যোগে নির্মাণ করা নজরখালি বাঁধ ধসে যাওয়ায় ঝুঁকিতে রয়েছে টাঙ্গুয়ার হাওরে সাড়ে ৫ হাজার হেক্টর বোরো জমির ফসল। বাঁধ রক্ষায় স্থানীয় হাওর পাড়ের কৃষকরা আপ্রাণ চেষ্টা চালালেও ফসল রক্ষায় কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। এতে নদীতে পানি বাড়লে যেকোনো সময় বাঁধ ভেঙে ফসল তলিয়ে যাওয়ার শঙ্কা করছেন হাওর পাড়ের কৃষকরা। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, নজরখালি বাঁধ টাঙ্গুয়ার পাড়ে হওয়ায় চলমান প্রকল্পের বাইরে। এজন্য সেখানে সরকারিভাবে কোনো বাঁধ তৈরি হয়নি। এ বাঁধটি স্থানীয় কৃষকরাই রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
জেলার বিভিন্ন হাওরের ফসল রক্ষায় ১৩২ কোটি টাকা বরাদ্দে ৭৩৪ প্রকল্পে ৫৯১ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। বাঁধের কাজ শতভাগ শেষ হওয়ায় প্রকৃতির আপদকালীন ঝুঁকি মোকাবেলায় নির্মিত বাঁধ সক্ষম বলে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার। তিনি বলেন, বাঁধ নির্মাণ কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। অন্যান্য যেকোনো বারের চেয়ে এবারের বাঁধ মজবুত হয়েছে। নদীতে পানি বাড়লে এর চাপ সহ্য করায় সক্ষম সব বাঁধ। বড় ধরনের কোনো বিপর্যয় না হলে বোরো ফসল ঝুঁকিমুক্ত বলে তিনি জানান।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উজানে বৃষ্টিপাতের ফলে পাহাড়ি ঢলে পানি প্রবেশ করে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় সুনামগঞ্জের সদর উপজেলার রঙ্গাচর ইউনিয়নে কাংলার হাওরের শতাধিক হেক্টর জমির বোরো ফসল তলিয়ে গেছে। ঝুঁকিতে রয়েছে অন্তত ২০০ হেক্টর জমির ফসল। তবে কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, নলুয়া হাওরে ৭০ হেক্টর জমির ফসল পানিতে নিমজ্জিত হলেও বৃষ্টিপাত না হলে তা ভাটিতে নেমে যেতে পারে। এতে ফসলের ক্ষতির পরিমাণ কম হবে বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম।
এদিকে বাঁধ নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের এমন আস্থায় বিশ্বাসী নয় হাওর ও কৃষকের সংগঠন হাওর বাঁচাও আন্দোলন। সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, নিধারিত সময়ের মধ্যে বাঁধের কাজ করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। শেষবেলায় অনেক তাড়াহুড়ো করে বাঁধ করা হয়েছে। এতে বাঁধের মাটির কম্পেকশন ঠিক হয়নি। অনেক বাঁধ নড়েবড়ে অবস্থায় রয়েছে। এসব দুর্বল বাঁধ পানির চাপ সহ্য করতে পারবে না। তাই আপদকালীন সময়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে সতর্ক থাকার আহ্বান সংগঠনের এ নেতার।
অপরদিকে আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস অনুযায়ী চলতি সপ্তাহে সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ এলাকায় বজ্রসহ কালবৈশাখী ঝড় ও বৃষ্টিপাত হতে পারে। তবে মেঘালয় চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা কম থাকার বিষয়টি হাওর অঞ্চলের জন্য স্বস্তির বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজিব হোসেন।
এবার সুনামগঞ্জ ১২ উপজেলার ছোট-বড় ১৪০টি হাওরে দুই লাখ ২৩ হাজার ৪৪৭ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। যা অতীতের চেয়ে বেশি বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ। আবাদকৃত জমি থেকে ১৩ লাখ ৫৫ হাজার মেট্রিক টন ধান উৎপাদনের সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম।
তিনি বলেন, এবার প্রকৃতি অনুকুলে থাকায় সুনামগঞ্জে ফসল ভালো হয়েছে। এরই মধ্যে ধান আগাম জাতের ধান কাটা শুরু হয়ে গেছে। আর কিছুদিন পরই পুরোদমে ধান কাটা শুরু হবে বলে তিনি জানান।