ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যের বার্তা, সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন

ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যের বার্তা, সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন

গণ-অভ্যুত্থানের পর নির্বাচন, সংস্কারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ কিংবা পাল্টাপাল্টি অবস্থান থাকলেও গোপালগঞ্জের ঘটনা সবাইকে আবার এক কাতারে নিয়ে এসেছে। দলগুলোর নেতারা নবগঠিত দল এনসিপির উপর হামলার কেবল প্রতিবাদই জানায়নি, আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শক্তির অবসানে ঐক্যের উপর জোর দিয়েছেন। একই সাথে পরিকল্পিতভাবে দেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটিয়ে গণতন্ত্রবিরোধী শক্তি নির্বাচন ব্যাহত করতে চায় কি-না সে ব্যাপারে দলগুলো সরকারকে সতর্ক বাতা দিয়েছে। অঘটনের শঙ্কা থাকা সত্ত্বেও অন্তর্বর্তী সরকার কেন গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশ ঘিরে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি তা নিয়েও রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রশ্ন উঠেছে।

গোপালগঞ্জে গত বুধবার গণ-অভ্যুত্থানের শক্তি জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশে আওয়ামী লীগ ও এর বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা নজিরবিহীন হামলা চালায়। হামলা ঠেকাতে গেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়, এতে প্রাণ হারায় অন্তত চারজন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন। কিন্তু তাতেও কাজ না হওয়ায় বুধবার রাত ৮টা থেকে গোপালগঞ্জে কারফিউ জারি করে অন্তর্বর্তী সরকার। এনসিপির অভিযোগ, তাদের নেতাদের হত্যার উদ্দেশ্যে জঙ্গি কায়দায় আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের সন্ত্রাসীরা এই হামলা চালিয়েছে।

এনসিপির ওপর এই হামলায় হতবাক হয়েছে গণ-অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত সব রাজনৈতিক দল। এই ঘটনা এমন সময় ঘটলো যখন অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতে নানা কর্মসূচি চলছে। গত বছরের জুলাই-আগস্টে রক্তক্ষয়ী গণবিপ্লবের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর এই প্রথম আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত গোপালগঞ্জে প্রতিরোধের মুখে পড়ে ওই বিপ্লবের নেতৃত্বে থাকা ছাত্রনেতারা।

গোপালগঞ্জে এনসিপির এই কর্মসূচি ঘিরে এক ধরনের শঙ্কার কথা দুই-একদিন আগে থেকেই শোনা যাচ্ছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক পেইজ থেকে প্রতিরোধের ডাক দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। তবুও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আশ্বাসে এনসিপি সেখানে সমাবেশ করতে গেলে বাধার মুখে পড়ে। গোপালগঞ্জ শহরে সমাবেশ স্থলে হামলা চালানো হয়। কয়েক ঘণ্টা ধরে চলা সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে আনে সেনাবাহিনী। হামলার আশঙ্কা সত্ত্বেও শুরুতে সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি ছিল নগণ্য, যা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এনসিপি সরকারের উপর এ হামলার দায় চাপিয়েছে। গতকাল অবশ্য হামলার ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এক বিবৃতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে বলেছে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, জনশৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং যে বা যারা যে কোনো ধরনের অবৈধ কার্যকলাপ, সহিংসতা ও মৃত্যুর জন্য দায়ী, তাদেরকে আইনানুগ জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে।

তবে বিভিন্ন ইস্যুতে বিরোধ থাকলেও বিএনপি গণ-অভ্যুত্থানের অগ্রণী শক্তির উপর হামলা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করেছে।

গোপালগঞ্জে হামলার ঘটনার দিন রাতে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়। বৈঠকে নেতারা বলেছেন, পরিকল্পিতভাবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নস্যাৎ করতে ফ্যাসিস্ট-বিরোধী আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালনকারী জাতীয় নাগরিক পার্টির সমাবেশে হাসিনা সমর্থকেরা হামলা চালিয়েছে। হামলা ও সংঘর্ষ চলাকালে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের ব্যর্থতা রয়েছে। বিএনপি এও বলেছে, রাজনৈতিক দলগুলো অত্যন্ত সতর্কতার সাথে তাদের কর্মসূচি নির্ধারণ করবে, অন্যথায় গণতন্ত্রবিরোধী শক্তিকে সুযোগ করে দেয়া হবে।

হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকর তৎপরতা দেখা যায়নি উল্লেখ করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বলেছে, পতিত আওয়ামী ফ্যাসিবাদের সন্ত্রাসী দোসররা এই হামলা চালিয়েছে। এনসিপির নেতৃবৃন্দ স্বাভাবিক নিয়মে প্রশাসনের সাথে পূর্ব থেকেই আলাপ-আলোচনা করে তাদের কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহায়তা চেয়েছেন। যেকোনো রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহযোগিতা করা প্রশাসনের দায়িত্ব। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকর তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি। এটি উদ্বেগজনক। জামায়াত ওই ঘটনার পর দেয়া বিবৃতিতে আরো উল্লেখ করে , গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন হয়েছে। কিন্তু দেশ এখনো ফ্যাসিবাদমুক্ত হয়নি। তারা দেশকে আবারও অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে অপতৎপরতা চালাচ্ছে।

ন্যক্কারজনক হামলা গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের সরাসরি লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করে হেফাজতে ইসলাম বলেছে, এ দেশে ফ্যাসিবাদের শিকড় উপড়ে ফেলা এখন সময়ের দাবি। হামলার ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।

এনসিপির কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্বহীনতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়ি, সমাবেশ মঞ্চ ভাঙচুরসহ দমন-পীড়নের নিন্দা জানিয়েছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। জোটের নেতারা বলেছেন, সরকারের এ ধরনের দায়িত্বহীন আচরণ আগামী দিনের গণতন্ত্রের পথচলাকে ব্যাহত করতে পারে।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেছেন, শেখ হাসিনার পেটোয়া বাহিনী গোপালগঞ্জে এনসিপির পদযাত্রায় হামলা করেছে। সাকি বলেন, ‘কত হাজার শহীদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা শেষ পর্যন্ত পালিয়ে গেছে। কিন্তু এখনো ষড়যন্ত্র থামেনি। শেখ হাসিনা ভারতে বসে বাংলাদেশে তার যে ষড়যন্ত্র, জনবিরোধী ও দেশবিরোধী তৎপরতা, সেটা চালিয়ে যাচ্ছে।’

এনডিএম’র চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আওয়ামী সন্ত্রাসীদের এরকম কিছু ঘটনার সুযোগ প্রশাসন করে দিয়েছে কি না আমরা তা জানতে চাই। ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচি ঘিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উত্তেজনা ছড়ানো হলেও দিনের শুরুতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রম ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। এনসিপির সমাবেশস্থলে প্রথমে হামলার সময় পুলিশ সদস্যরা উপস্থিত থাকলেও তারা কোনো অ্যাকশনে যায় নাই। সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের একটি লক্ষ্য এ ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হলেও আমরা আওয়ামী ক্যাডার বাহিনীর নতুন রূপে ফিরে আসার ঘটনায় মর্মাহত।

ববি হাজ্জাজ বলেন, আমরা রাজনৈতিকভাবে এই সরকারকে সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছি এবং আমরা আশা করব সরকার আমাদের উদ্বেগের বিষয়গুলো গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবে। গত বছর জুলাই মাসে যে ঐক্য আমরা দেখেছিলাম সরকারের কিছু ব্যক্তির কারণে সেই ঐক্যে যাতে আর ফাটল না ধরে আমরা সে ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক করছি। আশা করছি, প্রধান উপদেষ্টার প্রতিশ্রুত আগামী রমজান শুরুর আগেই জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হবে।

জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে গত বছরের আগস্ট থেকে রাজনীতিতে ঐক্যের সুবাতাস বইতে থাকে। ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব আন্দোলন দেশবাসীকেও এককাতারে নিয়ে আসে। কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সেই ঐক্যে কিছুটা হলেও ফাটল ধরতে দেখা যায়। নির্বাচন, সংস্কারসহ নানা ইস্যুতে দলগুলোর মতভেদ বৈরিতায় রূপ নেয়। দীর্ঘ আড়াই দশকের মিত্রশক্তি বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে বর্তমানে সব থেকে বেশি রাজনৈতিক বাদানুবাদ পরিলক্ষিত হচ্ছে। বাগি¦তণ্ডায় জড়িয়ে পড়েছে এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ আরো কিছু দল।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির মধ্যে অনৈক্য দেশের জন্য মোটেই কল্যাণকর নয়। তারা বলছেন, গোপালগঞ্জের ঘটনা প্রমাণ করেছে দেশ এখনো বিপদমুক্ত নয়। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে গণ-অভ্যুত্থানে জড়িত শক্তিগুলোর মধ্যে এ অবস্থায় কোনো দূরত্ব বা ভুল বোঝাবুঝি কাম্য নয়। এতে করে দেশে চলমান সংস্কার, গণহত্যার বিচার ও নির্বাচন প্রক্রিয়ার যারা বিরোধী, তারা উৎসাহিত ও বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে। অনৈক্য দেখা দিলে সেটা দেশের জন্য ভয়ানক বিপদ ডেকে আনতে পারে। সৌজন্যে: নয়াদিগন্ত