পিআর পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক: জামায়াতের দাবি, বিএনপির আশঙ্কা

পিআর পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক: জামায়াতের দাবি, বিএনপির আশঙ্কা

জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে আবারও রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ ছড়াতে শুরু করেছে। বৃহস্পতিবার জাতীয় মসজিদ বাইতুল মোকাররমের সামনে জামায়াতে ইসলামী বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে ৫ দফা দাবি উত্থাপন করে।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে দলের জেনারেল সেক্রেটারি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার জোর দিয়ে বলেন, “আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবশ্যই পিআর পদ্ধতিতে হতে হবে। জনগণের ভোটের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটানোর জন্য পিআর পদ্ধতি ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।”

এদিকে দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি পিআর পদ্ধতির বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান জানিয়েছে। বিএনপির শীর্ষ নেতারা মনে করছেন, পিআর পদ্ধতি চালু হলে দেশে আবারও রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হবে এবং স্বৈরাচারের পুনরুত্থান ঘটতে পারে।

পিআর পদ্ধতি কী?

পিআর বা প্রোপোশনাল রিপ্রোজেন্টেশন (অনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতিতে নির্বাচনে কোনো দল জাতীয়ভাবে যে পরিমাণ ভোট পায়, সংসদে তাদের আসন সেই অনুপাতে বণ্টন করা হয়। অর্থাৎ সরাসরি প্রার্থীর জয়-পরাজয়ের পরিবর্তে মোট ভোটের অনুপাতে দলীয় আসন নির্ধারিত হয়।

উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো দল জাতীয়ভাবে ২০ শতাংশ ভোট পায়, তবে তারা সংসদে ২০ শতাংশ আসন পাবে। এর ফলে ছোট দলগুলোও সংসদে প্রতিনিধিত্বের সুযোগ পায়।

জামায়াতের দাবি ও যুক্তি

জামায়াতে ইসলামী দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছে যে বিদ্যমান ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট (FPTP) পদ্ধতিতে তাদের জাতীয় ভোট শেয়ার থাকা সত্ত্বেও সংসদে প্রতিনিধিত্ব প্রায় থাকে না।

অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, “আমরা জনগণের ভোটে বিশ্বাস করি। যে দল যত ভোট পাবে, সেই অনুপাতে আসন পাবে এটিই গণতন্ত্রের প্রকৃত রূপ। পিআর পদ্ধতি চালু হলে জনগণের ভোটের মর্যাদা ফিরবে এবং বহুদলীয় গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে।”

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জামায়াতের মতো দলগুলোর জন্য পিআর পদ্ধতি রাজনৈতিকভাবে লাভজনক। কারণ তাদের নির্দিষ্ট ভোটব্যাংক থাকলেও তা সরাসরি আসন জেতার জন্য যথেষ্ট নয়। কিন্তু অনুপাতিক আসন বণ্টনের সুযোগ পেলে তারা সংসদে প্রবেশ করতে পারবে এবং জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব বাড়াতে পারবে।

বিএনপির আপত্তি ও আশঙ্কা

বিএনপি নেতাদের মতে, পিআর পদ্ধতি দেশে আরও রাজনৈতিক জটিলতা তৈরি করবে।

দলটির শীর্ষস্থানীয় এক নেতা বলেন, “পিআর পদ্ধতিতে ছোট ছোট দল সংসদে প্রবেশ করবে এবং সরকার গঠন আরও দুর্বল হবে। এতে একটি স্থিতিশীল সরকার গঠন করা কঠিন হবে, যা দেশের জন্য বিপজ্জনক।”

তাদের আশঙ্কা, পিআর পদ্ধতি বর্তমান ক্ষমতাসীনদের জন্য সুবিধাজনক হতে পারে। তারা ছোট দলগুলিকে নিয়ে জোট তৈরি করে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখাতে পারবে এবং রাজনৈতিক বিরোধিতাকে দুর্বল করতে পারবে।

বিএনপি মনে করে, এটি জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের চেয়ে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশকে বেশি গুরুত্ব দেবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল হক বলেন, “পিআর পদ্ধতি বিশ্বের বেশ কিছু দেশে সফলভাবে চালু রয়েছে, যেমন জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, ইসরাইল। তবে বাংলাদেশে এটি কার্যকর করতে হলে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা, রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র এবং শক্তিশালী জবাবদিহিমূলক সংসদ নিশ্চিত করতে হবে।”

তিনি আরও বলেন, “পিআর পদ্ধতিতে ছোট দলের কণ্ঠস্বর শোনা যায় ঠিকই, কিন্তু অতিরিক্ত দল সংসদে প্রবেশ করলে সরকার গঠন জটিল হয়ে পড়ে। এটি কখনো কখনো স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে পারে।”

পিআর পদ্ধতির সুবিধা

ভোটের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটে। ছোট দল ও সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্বের সুযোগ বাড়ে। বহুদলীয় গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়।

পিআর পদ্ধতির অসুবিধা

সংসদে অতিরিক্ত দল ঢুকলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ জটিল হয়। স্থিতিশীল সরকার গঠন কঠিন হয়ে যায়। চরমপন্থী বা বিভাজনমূলক দলগুলোর প্রভাব বাড়তে পারে।

জনগণের প্রতিক্রিয়া

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। অনেকেই মনে করছেন, পিআর পদ্ধতি চালু হলে ভোটের মূল্য বাড়বে এবং জনগণের আস্থা ফিরবে।

আবার কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, অতিরিক্ত দল সংসদে গেলে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়বে এবং সরকার দীর্ঘমেয়াদে কার্যকরভাবে কাজ করতে পারবে না।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে পিআর পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা নতুন কিছু নয়। তবে জামায়াতের নতুন করে দাবি এবং বিএনপি’র তীব্র বিরোধিতা আগামী নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনকে আরও উত্তপ্ত করতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ বিষয়ে জাতীয় সংলাপ ও ঐকমত্য প্রয়োজন। অন্যথায় এই বিতর্ক রাজনীতিতে নতুন বিভাজন তৈরি করতে পারে।