ভ্যানচালক থেকে শত কোটি টাকার মালিক চেয়ারম্যান
জীবিকার প্রয়োজনে এক সময় ভ্যানগাড়ি চালাতেন সিরাজগঞ্জের নবীদুল ইসলাম। কখনও দিনমজুর কখনও বাসের হেলপার হয়ে পেট চালাতে হয়েছে তাকে। আর আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে সেই ব্যক্তির কপাল খুলে যায়। ভ্যানচালক থেকে কোটিপতিতে পরিণত হন তিনি।
নবীদুলের বর্তমানে তিনটি বিলাসবহুল বাড়ি রয়েছে। রাজধানী ঢাকায় রয়েছে ৫টি ফ্ল্যাট, কক্সবাজারেও একটি বাড়ি আছে তার। তার মালিকানায় রয়েছে ২২টি ট্রাক, একটি মাইক্রোবাস ও বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেল।
এছাড়া সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন গ্রামে একাধিক কৃষি-অকৃষি জমি কিনেছেন নবীদুল। আওয়ামী শাসনের গত ১৫ বছরে অবৈধ উপার্জনের মাধ্যমে ভ্যানচালক নবীদুল শূন্য থেকে কয়েকশত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।
সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার সয়দাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নবীদুল ইসলাম। কিশোর বয়সে অপরাধ জগতে জড়িয়ে পড়া নবীদুল এক সময় ছিলেন চরমপন্থি দলের কনিষ্ঠ সদস্য। সেখান থেকে আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ২০০৯ সালে দল ক্ষমতায় গেলে বদলে যেতে থাকে তার ভাগ্যের চাকা।
অল্পদিনেই উত্তরাঞ্চলের প্রবেশদ্বার বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমে সয়দাবাদ এলাকার একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে যান নবীদুল। বাগিয়ে নেন ইউনিয়ন আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ। নির্বাচিত হন ইউপি চেয়ারম্যানও।
সরেজমিনে বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম এলাকার সয়দাবাদ পুনর্বাসন, সয়দাবাদ, পঞ্চসারটিয়া, মুলিবাড়ী ও বাঐতারা এলাকার বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের কথা বলে জানা যায়, চরমপন্থি দলের সদস্য হিসেবে ১৯৯৮ সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন নবীদুল। ওই সময় সয়দাবাদ ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা বেলাল হত্যা মামলায় তাকে আসামি করা হয়। তবে স্বাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে মামলা থেকে খালাস পেয়ে যান।
২০০৪ সালে মুলিবাড়ী ওয়ার্ড যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। যুবলীগের পদ পেয়েই দলের মধ্যে নিজের আধিপত্য বাড়াতে সচেষ্ট হন। ২০১০ সালে মুলিবাড়িতে খালেদা জিয়ার জনসভায় ট্রেন পোড়ানোর ঘটনাটি নবীদুলের জীবনের টার্নিং পয়েন্ট হয়ে আসে। ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া একাধিক মামলায় হাজার-হাজার বিএনপি নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়।
এসব মামলাকে পুঁজি করে বিএনপি নেতাকর্মী ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিপুল অর্থ চাঁদাবাজি করেছেন নবীদুল, এমন অভিযোগ রয়েছে।
২০১৫ সালে উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা সাইফুল ইসলাম হত্যা মামলাতেও একইভাবে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।
অর্থ ও সম্পদ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সখ্য বাড়তে থাকে নবীদুলের। ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়াতে নিজস্ব বাহিনী গড়ে তোলেন তিনি। ২০১৫ সালে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তখন থেকেই হয়ে ওঠেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ডা. হাবিবে মিল্লাতের একান্ত আস্থাভাজন।
২০১৬ নৌকা প্রতীকে ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালে দ্বিতীয়বারের মতো দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০২০ সালে তার অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে একাধিক মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশ হয়। তার অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে দুদকও তৎপর হয়। কিন্তু অদৃশ্য ইশারায় ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যান নবীদুল।
দলের ভেতরে-বাইরে ব্যাপক সমালোচনা থাকার পরও ২০২১ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আবারও নৌকা প্রতীক বাগিয়ে নেন এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।
শোনা যায়, সে সময় দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামালের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকার কারণেই মনোনয়ন বাগিয়ে আনতে সক্ষম হন নবীদুল। এভাবেই ধীরে ধীরে অপ্রতিরোধ্য হওয়া নবীদুল সয়দাবাদ এলাকার গডফাদারে পরিণত হন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি বলেন, গত ১৫ বছরে বৈধ-অবৈধ বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ, মহাসড়কে লোড-আনলোডিং পয়েন্ট নিয়ন্ত্রণ, নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেডের শ্রমিক নিয়োগ, প্রতিষ্ঠানটির পুরাতন মালামাল ক্রয়-বিক্রয়ের টেন্ডার, শিল্পপার্ক ও ইকোনমিক জোনে মাটি ভরাট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতুতে শ্রমিক নিয়োগসহ এলাকার সকল ঠিকাদারি কাজই ছিল নবীদুলের নিয়ন্ত্রণে। এলাকায় ব্যবসা করতে নবীদুলকে কমিশন দিতে হয়েছে, নয়তো অংশীদার করতে হয়েছে।
এভাবে অবৈধ উপায়ে দুহাত ভরে অর্থ উপার্জন করতে থাকেন নবীদুল। এলাকায় কথিত আছে, তিনি কখনও লাখের হিসেব করতেন না। কোটি কোটি টাকার হিসাব করতেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মুলিবাড়ী এলাকায় পৈত্রিক ভিটার ওপর দ্বিতল একটি ভবন, মুলিবাড়ী-সিরাজগঞ্জ সড়ক পশ্চিম পাশে ৫ তলা ও পূর্ব পাশে আরও একটি ভবন রয়েছে তার। ঢাকায় ৫টি ফ্ল্যাট ও কক্সবাজারে একটি বাড়ি রয়েছে। ২২টি ট্রাক ছিল তার যার ১৫/১৬টি ইতোমধ্যে বিক্রি করে দিয়েছেন তিনি। ৪০ লাখ টাকা মূল্যের একটি নোয়া মাইক্রোবাসে চলাচল করতেন নবীদুল। এছাড়াও নিজ গ্রাম মুলিবাড়ী, পূর্ব মোহনপুর, পঞ্চসোনা, জগতলা এলাকায় একাধিক কৃষি-অকৃষি জমিও রয়েছে তারা। বাড়ির পাশেই রয়েছে একটি গরুর খামার।
নবীদুল ইসলাম তার এলাকায় কোনো বিরোধীমত সহ্য করতে পারতেন না। তার বিরুদ্ধে একাধিক বিএনপি নেতাকর্মীকে মারধর এবং হত্যার অভিযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, নিজ দলে তার মতের বিরোধীদের ওপরও চলতো অমানুষিক নির্যাতন। যুবদল নেতা আকবর আলীকে গুলি করে হত্যা, বিএনপি নেতা শহীদকে মারপিট, আওয়ামী লীগ নেতা হাজী মজনু ও মোয়াজ্জেমের ওপর একাধিক হামলা ও মিথ্যা মামলা দায়েরের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
সয়দাবাদ ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এম এ শহীদ বলেন, ২০২২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি নবীদুল চেয়ারম্যানের নির্দেশে সয়দাবাদ ইউনিয়ন যুবদলের আহ্বায়ক আকবর আলীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। একই বছর ২২ নভেম্বর কড্ডার মোড় এলাকায় আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে কুপিয়ে জখম করা হয়। এছাড়াও বাঐতারা গ্রামের বিএনপি নেতা জাহাঙ্গীর ও বাবলু মোহনপুর পশ্চিমপাড়ার জবানকে অমানুষিক নির্যাতন করেছেন নবীদুল।
গত ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যুবদল ও ছাত্রদলের তিন নেতাকর্মী নিহতের মামলায় সাবেক এমপি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে নবীদুলকেও আসামি করা হয়েছে। পরদিন ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে তিনি পলাতক রয়েছেন। যে কারণে সম্পদ ও অভিযোগগুলোর বিষয়ে নবীদুল ইসলামের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।