ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া পশ্চিমা নেতাদের ‘মান রক্ষা’র একটি উপায়?

ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া পশ্চিমা নেতাদের ‘মান রক্ষা’র একটি উপায়?

ফিলিস্তিনিকে রাষ্ট্র হিসেবে  আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও পর্তুগাল। রবিবার (২১ সেপ্টেম্বর) দেশগুলো আলাদাভাবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়। শিগগিরই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেবে বলে ঘোষণা দিয়েছে আরেক প্রভাবশালী পশ্চিমা দেশ ফ্রান্স। গাজায় চলমান ইসরায়েলি যুদ্ধ এবং অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের ভূখণ্ড সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে এটি একটি প্রতীকী প্রতিক্রিয়া।

এই স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে বর্তমানে জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্যদেশের প্রায় ৭৫ শতাংশের স্বীকৃতি পেল ফিলিস্তিন। তবে ইসরায়েল এর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতির ঘোষণার ঠিক আগে, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মুখপাত্র শোশ বেদ্রোসিয়ান এই পদক্ষেপকে ‘অবাস্তব এবং শুধুমাত্র সন্ত্রাসবাদের জন্য পুরস্কার’ হিসেবে উল্লেখ করেন।

পূর্ব জেরুজালেমে গত ১৫ সেপ্টেম্বর  এক অনুষ্ঠানে নেতানিয়াহু তার সমর্থকদের জানান,‘কোনও ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র থাকবে না।’

যদিও কানাডা, যুক্তরাজ্য এবং অস্ট্রেলিয়ার এই পদক্ষেপ বিশ্বব্যাপী মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। অনেক শিরোনাম তৈরি করেছে। বিশ্লেষকরা কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে বলেছেন, এটি প্রায় ৭ লাখ ফিলিস্তিনির চলমান অবমাননা,হত্যা ও বাস্তুচ্যুতির মধ্যে একটি ছোট, প্রতীকী পদক্ষেপ। তবে এটি কিছু গুরুত্বও বহন করে।

ফিলিস্তিনি রাজনীতি বিজ্ঞানী রিদা আবু রাস আল জাজিরাকে বলেন, “স্বীকৃতি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ঘনিষ্ঠ মার্কিন মিত্ররা এখন পর্যন্ত ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া থেকে বিরত ছিল যতক্ষণ না কোনও চূড়ান্ত সমঝোতা হয়। এটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই দেশগুলো রীতি ভেঙেছে। এর ফলে ইসরায়েল আরও আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় চলে এসেছে। আমার মনে হয় এটা তাৎপর্যপূর্ণ। আমার মনে হয় এটা তাৎপর্যপূর্ণ।’

প্রদর্শনমূলক স্বীকৃতি?

ইসরায়েলের আগ্রাসনের মধ্যে স্বীকৃতি ফিলিস্তিনিদের বসবাসের বাস্তব পরিস্থিতি উন্নত করতে পারবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা।

বিশ্লেষকরা বলেন, রবিবারের পদক্ষেপের পরও ইসরায়েলের যুদ্ধ, যা ইসরায়েলি এবং আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার গোষ্ঠী গণহত্যা হিসেবে উল্লেখ করেছেন, শেষ হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

দোহা ইনস্টিটিউটের প্রফেসর মোহামাদ এলমাসরি আল জাজিরাকে বলেন, এই পদক্ষেপ মূলত প্রদর্শনমূলক। তিনি বলেন, আমি মনে করি তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং নিজের দেশের স্থানীয় জনগণের ক্রমবর্ধমান চাপের কারণে কিছু করতে বাধ্য হয়েছে। আমার মতে,এটি বাস্তব পদক্ষেপ না নিয়ে তারা কিছু করেছে বা করেছে বলে বলার একটি উপায়।

স্বীকৃতির কিছু অর্থ রয়েছে

এই স্বীকৃতির মাধ্যমে তিনটি দেশ—কানাডা, যুক্তরাজ্য এবং অস্ট্রেলিয়া—এখন ফিলিস্তিনি সরকারের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক চুক্তি করতে পারবে এবং তাদের দেশে পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রদূত পাঠাতে পারবে। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাজ্য হুসাম জমলোটকে তাদের দেশে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ করবে।

আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোতে যোগদান

বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ ইতোমধ্যেই ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এখন শুধু যুক্তরাষ্ট্র, কয়েকটি ইউরোপীয় ও বাল্টিক দেশ, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান এবং কয়েকটি অন্যান্য দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়নি। তবে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিলেও, দেশটি এখনও জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য রাষ্ট্র নয়।

আবু রাস বলেন, স্বীকৃতি কোনও নতুন জাতিসংঘ সুবিধা দেয় না। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ছাড়া এটি ফিলিস্তিনকে নতুন আন্তঃসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পূর্ণ সদস্য হওয়ার সুযোগ দেয় না। 

তিনি আরও বলেন, ফিলিস্তিন বর্তমানে একটি ‘অসদস্য পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র’। পূর্ণ সদস্য হতে হলে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সুপারিশের পর (যা সাধারণ পরিষদের ভোটের মাধ্যমে) অনুমোদন প্রয়োজন—যা যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোর কারণে অপ্রত্যাশিত। তবুও এটি একটি প্রথম ধাপ হতে পারে। কারণ ইসরায়েলকে গাজার ওপর যুদ্ধ শেষ করতে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে, বিশেষ করে ইউরোপ থেকে। বয়কট অভিযানগুলো গতিশীল হচ্ছে,যা ইসরায়েলকে ইউরোভিশন থেকে বাদ দেওয়া এবং আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখতে পারে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্প্রতি কিছু ইসরায়েলি পণ্যের শুল্ক বাড়ানো এবং কিছু ইসরায়েলি নেতাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়ে আলোচনা করেছে।

আবু রাস বলেন, ‘স্বীকৃতি গাজায় ইসরায়েলের কার্যকলাপে সরাসরি প্রভাব ফেলে না। তবে এটি এই দেশগুলোর বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়ার ইচ্ছার সংকেত দিতে পারে, যা গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডে সরাসরি প্রভাব ফেলবে। যেমন: দ্বিপাক্ষিক অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা—অর্থাৎ ইসরায়েলকে অস্ত্র বিক্রি না করা এবং ইসরায়েলি উৎপাদক থেকে অস্ত্র না কেনা।'

নেতাদের ‘মান রক্ষা’

বিশ্লেষকরা বলছেন যে, এই নেতারা তাদের নিজের দেশের বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ চাপ এবং দাবির কারণে পদক্ষেপ নিচ্ছেন। পাশাপাশি সাধারণ জনগণের ক্রমবর্ধমান দাবি যে, রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়া হোক এবং ইসরায়েলের গণহত্যা ও সহিংসতা বন্ধ করার জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।

আবু রাস বলছেন, এই পদক্ষেপগুলো মূলত কেন্দ্রীয়-বামপন্থী সরকারগুলোর ওপর বাড়তে থাকা দেশীয় চাপের ফল। কোনো বাস্তব পরিবর্তন ঘটেনি, কিন্তু যা দেখা যাচ্ছে তা হলো ধীর এবং জমে থাকা প্রতিক্রিয়া—একটি ক্রমবর্ধমান উদার অসন্তোষ। এই পদক্ষেপগুলোকে নির্বাচনকারীদের চাহিদা কম খরচে মেটানোর একটি উপায় হিসেবে দেখা উচিত।

তিনি আরও বলেন, এরা নিজেদের মান রক্ষা করছে।

জুলাই মাসে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলেছেন যে, তিনি ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেবেন যদি ইসরায়েল গাজার ওপর যুদ্ধ শেষ করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ না নেয়। রবিবার স্টারমার আবারও জানান যে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিক্রিয়ায়। তিনি বলেন, এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে দুই-রাষ্ট্র সমাধানের উদ্দেশ্যকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য, এবং তিনি বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন যে এই সমাধানের ধারণা কমে যাচ্ছে।

অস্ট্রেলিয়া ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রক্রিয়াকে কিছু শর্তের সঙ্গে যুক্ত করেছে। প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ বলেছেন, যদি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ তাদের সংস্কারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আরও অগ্রগতি করে, তখন অস্ট্রেলিয়া কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করা এবং দূতাবাস খোলা সহ অন্যান্য পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয় বিবেচনা করবে।

বিশেষ দায়িত্ব

১০৮ বছর আগে, ব্রিটিশ সরকার বালফোর ঘোষণা স্বাক্ষর করে, যেখানে ফিলিস্তিনের জমিতে ইহুদিদের জন্য একটি জাতীয় গৃহ নির্মাণের সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়।

যুক্তরাজ্য ইতিহাসগতভাবে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের জন্য সহযোগী ছিল। তাই রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়াও অনেকের কাছে যুক্তরাজ্যের ফিলিস্তিনিদের স্থানচ্যুতি ও অধিকার হরণের সঙ্গে সম্পৃক্ততার স্বীকৃতি হিসেবে গণ্য হয়।

যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি জুলাই মাসে জাতিসংঘে এক বক্তৃতায় বলেন, যুক্তরাজ্যের উপর দুই-রাষ্ট্র সমাধানকে সমর্থন করার একটি বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে।

যদি বিশ্বের সব দেশ ফিলিস্তাইনকে স্বীকৃতি দেয়, তবুও ফিলিস্তিনিদের জীবনযাত্রা বা পরিস্থিতিতে খুব বেশি পরিবর্তন হবে না, যদি ইসরায়েলের দখল ও নিয়ন্ত্রণ বন্ধ বা ভেঙে না দেওয়া হয়।

তিনি আরও বলেন,  ফিলিস্তিনের পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু শুধু ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া যথেষ্ট নয়। এই চাপ আরও কার্যকর হতে হবে-যেমন: ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা, কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা এবং সাংস্কৃতিক বয়কটের মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

সূত্র: আল জাজিরা