স্টুডেন্ট ভিসায় ইউরোপ-আমেরিকার কড়াকড়ি, বিকল্প হতে পারে যেসব দেশ

স্টুডেন্ট ভিসায় ইউরোপ-আমেরিকার কড়াকড়ি সম্প্রতি বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য বিদেশে উচ্চশিক্ষা লাভে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পর্যাপ্ত আর্থিক সক্ষমতাসহ সব ডকুমেন্টস ঠিকঠাক থাকার পরও ‘রিজেক্ট’ (প্রত্যাখ্যান) হচ্ছে বহু ভিসা আবেদন। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের বিদেশে উচ্চশিক্ষার স্বপ্নপূরণে বিকল্প হয়ে উঠতে পারে চীন, রাশিয়া, তুরস্কসহ বেশ কিছু দেশ।
ইউরোপ-আমেরিকার ভিসা জটিলতায় বিকল্প হতে পারে যেসব দেশ, নিচে তাদের সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
স্টুডেন্ট ভিসার বর্তমান পরিস্থিতি: কেন ঝুঁকি?
ইউরোপে ব্যাকলগ ও কঠোরতা: জার্মানির মতো জনপ্রিয় গন্তব্যে অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা (১.৫-২.৭ বছর) এবং শেনজেন ভিসার প্রত্যাখ্যান রেট বৃদ্ধি (২০২৪-এ ২১ হাজারের বেশি বাংলাদেশি আবেদন বাতিল, যার মধ্যে স্টুডেন্ট ভিসাও রয়েছে) বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য দুর্ভোগ তৈরি করেছে। অবশ্য ফ্রান্স, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ডের মতো কিছু দেশে ভিসা প্রক্রিয়া এখনো সহজ।
আমেরিকায় কঠোর যাচাই: এফ-১ ভিসার জন্য আর্থিক প্রমাণ (৩৫-৫০ হাজার মার্কিন ডলার/বছর) এবং ইন্টারভিউতে কঠোরতার কারণে ভিসা প্রত্যাখ্যানের হার বেড়েছে। ২০২৪-এ প্রায় ২৫-৩০ শতাংশ আবেদন প্রত্যাখ্যান হয়েছে।
কানাডার সীমারোপ: ২০২৫-এ স্টাডি পারমিট ৩ লাখ ৬০ হাজারে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে (১০ শতাংশ কম), যা বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের আবেদনকে সীমিত করছে। তবে, স্কলারশিপধারীদের জন্য এখনো সম্ভাবনা রয়েছে।
শিক্ষার্থীদের উদ্বেগ: বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর ৩৫-৫০ হাজার শিক্ষার্থী বিদেশে পড়তে যায়। ভিসা জটিলতায় ২০২৫-এর ইনটেকে অনেকে সুযোগ হারাচ্ছেন, যা তাদের ক্যারিয়ার পরিকল্পনায় ধাক্কা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
বিকল্প গন্তব্য: কোথায় যাবেন?
বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষার জন্য সাশ্রয়ী, সহজ ভিসা প্রক্রিয়া, এবং ক্যারিয়ারবান্ধব গন্তব্য নিচে বর্ণনা করা হলো। এই দেশগুলো ২০২৫ সালে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে তাদের উদার ভিসা নীতি, কম খরচ, এবং ডিগ্রী পরবর্তী সুযোগের জন্য।
চীন
আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য অন্যতম সাশ্রয়ী, ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ, এবং মেডিসিন/ইঞ্জিনিয়ারিং-এ শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় সম্পন্ন দেশ চীন। টিউশন ফি বছরে ৩-৭ হাজার মার্কিন ডলার। লিভিং কস্ট পড়বে ৪-৬ হাজার ডলার। ভিসা প্রক্রিয়ায় লাগে ৪-৬ সপ্তাহ, অনুমোদনের হার প্রায় ৯০ শতাংশ। পড়াশোনা শেষে এক বছরের জন্য পোস্ট-স্টাডি ওয়ার্ক ভিসা পাওয়া যাবে। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের কাছে চীনের মেডিসিন (এমবিবিএস), ইঞ্জিনিয়ারিং ও বিজনেস বিষয়গুলো বেশি জনপ্রিয়।
রাশিয়া
কম টিউশন ফি এবং সহজ ভিসানীতির কারণে ভালো বিকল্প হতে পারে রাশিয়াও। দেশটি মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষায় বেশ জনপ্রিয়। বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ওপেন ডোরস স্কলারশিপ। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনার সুযোগ রয়েছে। পোস্ট-স্টাডি ওয়ার্ক ভিসা মেলে ৬ মাস থেকে ১ বছরের জন্য। ভিসা প্রক্রিয়া তুলনামূলক সহজ এবং বাংলাদেশিদের জন্য বড় কোনো বাধা নেই। তবে ভাষা ও আবহাওয়া মানিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
তুরস্ক
তুরস্কে একাধিক বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে বুরসলারি স্কলারশিপ। এটি একটি ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ, যা টিউশন ফি, থাকা-খাওয়া, মাসিক স্টাইপেন্ড সবকিছুই কভার করে। টিউশন ফি বছরে ৩–৮ হাজার ডলার, লিভিং কস্ট তুলনামূলক কম। পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ করার সুযোগ আছে (ক্যাম্পাসে ২০ ঘণ্টা/সপ্তাহ)। এক বছরের পোস্ট-স্টাডি ওয়ার্ক ভিসা দেয়।
মালয়েশিয়া
বলতে গেলে সবচেয়ে সাশ্রয়ী, মুসলিম-বান্ধব এবং সহজতর ভিসা প্রক্রিয়া। দেশটির ইউনিভার্সিটি অব মালায়া তো বিশ্বের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়। মালয়েশিয়ায় উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে টিউশন ফি লাগে বছরে ৩-৮ হাজার মার্কিন ডলার। ‘লিভিং কস্ট’ (থাকা-খাওয়ার খরচ) বছরে ৪-৬ হাজার ডলার। ভিসা প্রক্রিয়ায় লাগে ৪-৬ সপ্তাহ, অনুমোদনের হার বেশি। রয়েছে অনলাইনে আবেদনের সুবিধা। আইইএলটিএস স্কোর ৫.৫-৬.০ হলেই চলে। পড়াশোনার জন্য স্কলারশিপের ব্যবস্থা রয়েছে। পড়া শেষ হলে এক বছরের জন্য মিলবে পোস্ট-স্টাডি ওয়ার্ক ভিসা। দেশটির খাবার ও সংস্কৃতি একই ধরনের হওয়ায় বাংলাদেশিদের জন্য মানিয়ে নেওয়া অনেকটাই সহজ হবে।
সিঙ্গাপুর
বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে সিঙ্গাপুরে। হাই-টেক জব মার্কেট এবং দক্ষিণ এশিয়ার কাছাকাছি অবস্থান বাড়তি পাওনা হবে। টিউশন ফি বছরে ১৫-২৫ হাজার সিঙ্গাপুরিয়ান ডলার। লিভিং কস্ট লাগবে বছরে ৮-১২ হাজার সিঙ্গাপুরিয়ান ডলার। ভিসা প্রক্রিয়ায় সময় লাগে খুবই কম, ২-৪ সপ্তাহ। অনুমোদনের হারও সন্তোষজনক। পড়াশোনা শেষে এক বছরের জন্য পোস্ট-স্টাডি ওয়ার্ক ভিসা পাওয়া যাবে। এখানেও বাংলাদেশি কমিউনিটি ও হালাল খাবারের বাড়তি সুবিধা রয়েছে।
জাপান
প্রযুক্তি এবং ইঞ্জিনিয়ারিং-এ বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে জাপানে। রয়েছে ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ এবং এবং পার্ট-টাইম জবের সুবিধাও (২৮ ঘণ্টা/সপ্তাহ)। টিউশন ফি বছরে ৫-১০ হাজার মার্কিন ডলার। থাকা-খাওয়ার খরচ ৭-১০ হাজার ডলার প্রতি বছর। ভিসা প্রক্রিয়ায় লাগে ১-২ মাস। পড়াশোনা শেষে এক বছরের জন্য পোস্ট-স্টাডি ওয়ার্ক ভিসা পাওয়া যাবে।
কানাডা
একাধিক বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়, বিশাল বাংলাদেশি কমিউনিটিসহ কানাডায় নানা সুবিধা পেয়ে থাকেন শিক্ষার্থীরা। পড়াশোনা শেষে ১-৩ বছরের পোস্ট গ্রাজুয়েশন ওয়ার্ক পারমিট (ডিজিডব্লিউপি) এবং পার্মানেন্ট রেসিডেন্সি (পিআর) পাওয়ার পথও খোলা। সম্প্রতি দেশটি স্টুডেন্ট ভিসায় সীমা আরোপ করলেও স্কলারশিপধারীদের অগ্রাধিকার দিচ্ছে। কানাডায় টিউশন ফি বছরে ১৫-৩০ হাজার কানাডীয় ডলার। থাকা-খাওয়ার জন্য লাগতে পারে আরও ১০-১৫ হাজার কানাডীয় ডলার। ভিসা প্রক্রিয়ায় ৪-৮ সপ্তাহ লাগে, তবে ব্যাকলগের কারণে বিলম্ব হতে পারে।
অস্ট্রেলিয়া
উদার অভিবাসন নীতির পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের পার্ট-টাইম জব (২০ ঘণ্টা/সপ্তাহ) এবং পোস্ট-স্টাডি ওয়ার্ক ভিসা (২-৪ বছর) সুবিধা দিয়ে থাকে অস্ট্রেলিয়া। তাই বাংলাদেশিদের কাছে দেশটি অন্যতম জনপ্রিয় গন্তব্য। অস্ট্রেলিয়ায় টিউশন ফি সাধারণত ২০-৪০ হাজার অস্ট্রেলীয় ডলার প্রতি বছরে। থাকা-খাওয়ার খরচ লাগে ১২-১৮ হাজার অস্ট্রেলীয় ডলার প্রতি বছর। ভিসা প্রক্রিয়ায় সময় লাগে ৪-৬ সপ্তাহ, অনুমোদনের হারও ভালো। বাংলাদেশিদের জন্য বাড়তি পাওনা হবে সিডনি বা মেলবোর্নে বিশাল বাংলাদেশি কমিউনিটি এবং সহজলভ্য হালাল খাবার।
মধ্যপ্রাচ্য
মধ্যপ্রাচ্যের সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, সৌদি আরবের মতো দেশগুলো ভালো বিকল্প হতে পারে। এসব দেশে বেশ কিছু খ্যাতনামা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা রয়েছে (যেমন- আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব দুবাই, কাতার ইউনিভার্সিটি)। সৌদির অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ দেয়, গবেষণার সুযোগ রয়েছে। ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনার সুযোগ আছে, আরবি শেখা বাধ্যতামূলক নয়। এছাড়া, সংযুক্ত আরব আমিরাতে লিভিং কস্ট তুলনামূলক বেশি, তবে ১-২ বছর পোস্ট-স্টাডি ওয়ার্ক ভিসা পাওয়া যায়।
পরামর্শ
ইউরোপ ও আমেরিকার ভিসা জটিলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, জাপান, চীন, রাশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য দুর্দান্ত বিকল্প। এই দেশগুলো সাশ্রয়ী শিক্ষা, সহজ ভিসা, এবং ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ দেয়। তাই আগ্রহী শিক্ষার্থীদের উচিত এখনই প্রস্তুতি শুরু করা—বিশেষ করে স্কলারশিপ এবং অ্যাডমিশন প্রক্রিয়ার জন্য। সঠিক পরিকল্পনায় উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব।
বিস্তারিত তথ্যের জন্য নির্দিষ্ট দেশের দূতাবাস বা সরকারি ওয়েবসাইট দেখুন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওয়েবসাইটেও অনেক তথ্য পাবেন। একটু ঘাটাঘাটি করলে নিজেই সব তথ্য বের করতে পারবেন, ফলে প্রতারকের খপ্পরে পড়ার ঝুঁকি কমবে।