ছাত্ররাজনীতি থাকবে কি থাকবে না
সম্প্রতি প্রথম আলোর ফেসবুক পেজে ছাত্ররাজনীতির বিষয়ে একটি জরিপ চালানো হয়। জরিপে প্রশ্ন করা হয়, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা উচিত বলে মনে করেন কি?’ এই জরিপে সাড়ে তিন লাখের বেশি মানুষ অংশ নেন। তাঁদের মধ্যে ৯৩ শতাংশ মনে করেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা উচিত। ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা উচিত নয় বলে মনে করেন মাত্র ৫ শতাংশ মানুষ। বাকি ২ শতাংশ পক্ষে-বিপক্ষে কোনো মত দেননি।
এ ধরনের জরিপ থেকে কোনো একটি বিষয়ে মানুষের প্রাথমিক মনোভাব বোঝা যায়। তবে সব ক্ষেত্রে এখান থেকে সরাসরি সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। যেমন জরিপের প্রশ্ন যদি এমন হতো ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা উচিত বলে মনে করেন কি?’ তাহলেও বিপুলসংখ্যক মানুষ ‘হ্যাঁ’ বলতেন। সেই ‘হ্যাঁ’ সরাসরি ছাত্ররাজনীতি বন্ধের পক্ষে মত প্রকাশ করত না। তার মানে, ছাত্ররাজনীতি থাকা আর দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি থাকা এক কথা নয়।
ছাত্রদের রাজনীতি-সচেতন করে তোলা এবং শুভ রাজনীতির চর্চায় রাখা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির স্বার্থেই প্রয়োজন। তবে এর আগে রাজনৈতিক দলগুলোর গঠনতন্ত্রে বা কার্যক্রমে পরিবর্তন আনতে হবে
ছাত্ররাজনীতির ব্যাপারে মানুষের বিরূপ মনোভাব তৈরি হওয়ার পেছনে যথেষ্ট কারণ আছে। প্রায় সাড়ে তিন দশক ধরে দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্ষমতাসীন দলের অনুসারী ছাত্রসংগঠনগুলো ছাত্ররাজনীতির নামে অপরাজনীতি চালিয়েছে। ক্যাম্পাসে তারা বিরোধী মতকে দাঁড়াতে দেয়নি।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে প্রশাসনের তোয়াক্কা না করে ‘গণরুম’ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ইচ্ছেমতো সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করেছে। এই সূত্রে তাদের মিছিলে যেতে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে হামলা-সংঘর্ষে অংশ নিতে বাধ্য করেছে।
ছাত্রসংগঠনগুলোর দলীয় কোন্দলে দলের ভেতরে-বাইরে হত্যা-খুনের মতো ঘটনাও ঘটেছে। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অপহরণ, ধর্ষণের মতো নানা কার্যকলাপের অভিযোগ ছিল এসব সংগঠনের বিরুদ্ধে।
অভিযোগ ছিল ভর্তি পরীক্ষা ও চাকরির পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের, আর বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী এমনকি শিক্ষক নিয়োগে খবরদারির। তাদের অনেক অপকর্ম ও ঘটনা সম্পর্কে সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্তাব্যক্তিরা অবগত ছিলেন। অথচ কার্যত এর প্রতিকারে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। ফলে দিন দিন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন।
এক অর্থে বলা যায়, সরকারের পক্ষ থেকে তাদের অনুগত ছাত্রসংগঠনকে প্রতিপালন করা হতো। ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য ছাত্রদের সন্ত্রাসী কার্যক্রমকে বাধা দেওয়া হয়নি; বরং প্রকারান্তরে উৎসাহিত করা হয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা সব সময় অভিযোগ করেছে, লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি ভিন্নমত দমনেই কাজ করেছে।
শিক্ষার্থীদের দাবি আদায়ের যৌক্তিক আন্দোলনে লাঠিসোঁটা আর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালিয়েছে। সরকার-সমর্থিত ছাত্রসংগঠনের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ক্যাম্পাসে সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে রীতিমতো ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেছিল।
অথচ একই সঙ্গে স্বীকার করতে হয়, বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির রয়েছে ঐতিহাসিক গৌরবজনক ভূমিকা। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এবং পরবর্তীকালে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ও সর্বশেষ চব্বিশের আন্দোলনে ছাত্ররা মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। তবে অতীতের গৌরবজনক ভূমিকা উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি থাকা না-থাকার বাধ্যবাধকতা তৈরি করে না। কিংবা এই গৌরবকে অবলম্বন করে ক্যাম্পাসে বা ক্যাম্পাসের বাইরে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ পরিচালনা করারও বৈধতা দেয় না।
তবে বাস্তব কথা এই, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ সচল থাকলে অনেক সমস্যারই সমাধান হতো। ছাত্র সংসদ শিক্ষার্থীদের অধিকার ও রাজনীতি সচেতন করে তোলে এবং তাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চার সুযোগ তৈরি করে।
কিন্তু বছরের পর বছর ধরে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় না। দেশের চারটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বশেষ ১৯৯০ থেকে ১৯৯২ সালের মধ্যে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছে। মাঝখানে ২০১৯ সালে একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছে। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগ ফলাফল নিয়ন্ত্রণের জন্য সব রকম চেষ্টাই করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও সেই নির্বাচনকে পুরোপুরি অবাধ করতে পারেনি। অথচ ক্ষমতাসীন দলের পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে এসব নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারত।
সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ছাত্রসংগঠনগুলো যেমন স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে, তেমনি এসব সংগঠন ‘লেঠেল’ বাহিনীতে পরিণত হয়ে সরকারকে স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে সহায়তা করে। তবে সাধারণ শিক্ষার্থী ও মানুষ যে ছাত্রসংগঠনগুলোর এই ভূমিকা পছন্দ করে না, তা নানা সময়ের অভিমত ও জনমত জরিপে প্রকাশিত হয়েছে।
এবারের ছাত্র–জনতার আন্দোলন তো এটাও দেখিয়ে দিল, সরকারপক্ষ যে ছাত্রসংগঠনকে তাদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার শক্তি মনে করত, সেই ছাত্রসংগঠনই তাদের ক্ষমতা হারানোর ইন্ধন হয়ে উঠল। গত ১৫ বছরে ক্ষমতার দম্ভে ফুলেফেঁপে ওঠা ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্ষোভের বিস্ফোরণ এই আন্দোলনে লক্ষ করা গেছে।
ছাত্ররা নিজেরাও কি ছাত্ররাজনীতি চায় না? ২০১৯ সালে বুয়েটে আবরার ফাহাদ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের নির্মম অত্যাচারে প্রাণ হারায়। এরপর সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে সেখানে প্রজ্ঞাপন জারি করে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এ বছরের এপ্রিল মাসে হাইকোর্ট সেই প্রজ্ঞাপনকে স্থগিত করলে বুয়েটে আবার আন্দোলন শুরু হয়। তখন সাধারণ ছাত্ররা লিখিত বক্তব্যে বলে, ‘যে ছাত্ররাজনীতি র্যাগিংয়ের সংস্কৃতিকে প্রশ্রয় দেয়, ক্ষমতার অপব্যবহারের পথ খুলে দেয়, যার বলি হতে হয় নিরীহ শিক্ষার্থীদের, তা আমাদের জন্য ভালো কিছু কখনোই বয়ে আনেনি, আনবেও না।’
ছাত্রদের রাজনীতি-সচেতন করে তোলা এবং শুভ রাজনীতির চর্চায় রাখা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির স্বার্থেই প্রয়োজন। তবে এর আগে রাজনৈতিক দলগুলোর গঠনতন্ত্রে বা কার্যক্রমে পরিবর্তন আনতে হবে। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রদের বা ছাত্রসংগঠনের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ রাখার বা প্রভাব খাটানোর অধিকার সম্পূর্ণ বাতিল করতে হবে। ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি থাকবে কি না, থাকলে কোন আঙ্গিকে থাকবে, এসব নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোরও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা দরকার।
তবে সবার আগে দরকার ছাত্ররাজনীতি এবং প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয় নিয়ে উন্মুক্ত আলোচনার সুযোগ তৈরি করা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদকে কার্যকর করা সম্ভব হলে এ নিয়ে অধিক কিছু ভাবার প্রয়োজন হয়তো হবে না।