গোলাপগঞ্জে নির্মম হত্যাযজ্ঞের বিচারের আশায় ৭ শহীদ পরিবার

আজ ৫ আগস্ট। ২০২৪ সালের এই দিনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকার দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যায়। এই অভ্যুত্থানে পুলিশ-বিজিবির গুলিতে প্রাণ দিয়েছেন গোলাপগঞ্জ উপজেলার ৭ সূর্য সন্তান।
নির্মম হত্যাযজ্ঞের বছর পেরিয়ে গেলেও স্বজন হারানোর বেদনা এখনো ভুলতে পারেনি ৭ শহিদের পরিবার। উদ্বেগ, শঙ্কা আর আক্ষেপ নিয়ে কাটছে শহীদ পরিবারগুলোর দিন। স্বজন হারানোর ন্যায় বিচার পাওয়া নিয়েও রয়েছে সংশয়।
তরতাজা এই প্রাণগুলো আর কখনও ফিরবেন না, তবে তাদের হত্যার বিচার দেখতে চায় শহিদ পরিবারগুলো। এটাই এখন প্রশাসনের কাছে তাদের একটাই চাওয়া৷
জুলাই অভ্যুত্থানে গোলাপগঞ্জে নিহত সাতজন হলেন, উপজেলার ঢাকাদক্ষিণ ইউনিয়নের নিশ্চিন্ত গ্রামের মৃত তৈয়ব আলীর ছেলে নাজমুল ইসলাম (২৪), একই ইউনিয়নের দক্ষিণ রায়গড় গ্রামের মৃত ছুরাই মিয়ার ছেলে জয় আহমদ (১৮), পশ্চিম আমুড়া শিলঘাট গ্রামের কয়ছর আহমদের ছেলে সানি আহমদ (২২), ঢাকাদক্ষিণ ইউনিয়নের বারকোট গ্রামের মৃত মকবুল আলীর ছেলে তাজ উদ্দিন (৩৯), একই ইউনিয়নের দত্তরাইল গ্রামের আলা উদ্দিনের ছেলে মিনহাজ আহমদ (২৩), পৌর এলাকার উত্তর ঘোষগাঁও গ্রামের মোবারক আলীর ছেলে গৌছ উদ্দিন (৩৫) ও কানিশাইল গ্রামের মো.পাবেল আহমদ কামরুল (২৩)।
তাদের মধ্যে পাবেল শহীদ হয়েছেন ৫ আগস্টের এই দিনে সিলেট নগরীর ক্বীন ব্রিজ এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে। বাকি ছয়জন শহীদ হন ৪ আগস্ট।
কী ঘটেছিল ৪ আগস্ট
রোববার আনুমানিক ১০টা বা সাড়ে ১০টা৷ তখন উপজেলার ঢাকাদক্ষিণ সরকারি কলেজের সামনে থেকে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ঢাকাদক্ষিণ চৌমুহনীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। বিক্ষোভ মিছিল হবে খবর পেয়ে সাবেক উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) অভিজিত চৌধুরী ও গোলাপগঞ্জ মডেল থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাছুদুল আমিনের নেতৃত্বে ঢাকাদক্ষিণ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান নেয় বিপুল সংখ্যক পুলিশ ও বিজিবি। শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ মিছিল কলেজের সামনে আসা মাত্র বাঁধা দেয় পুলিশ৷ বাঁধা অতিক্রম করে নানা স্লোগান দিয়ে এগুতে থাকে মিছিলটি।
একপর্যায়ে দুপক্ষের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিলে পুলিশ-বিজিবিকে ধাওয়া করে বিক্ষুব্ধরা। এসময় বিজিবির গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। কিন্তু মুহুর্তের মধ্যেই পাল্টে যায় ঘটনার মোড়। ছাত্র-জনতা মিছিল সহকারে গোলাপগঞ্জের দিকে অগ্রসর হতে থাকলে, ঢাকাদক্ষিণ ব্র্যাক অফিসের পাশে থেকে ছাত্রদের লক্ষ্য করে গুলি, টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়তে থাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গুলিতে ঝাঝরা হয়ে যায় অনেকের শরীর। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে আশপাশের মসজিদে মসজিদে মাইকিং করা হয় সকল মানুষ যাতে রাস্তায় নেমে আসেন। দুপুর ১২টার দিকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পাশে অবস্থান নেয় পুলিশ ও বিজিবি। সেখানে যাওয়া মাত্র আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে ফের গুলি ছুড়তে থাকে তারা।
এসময় তাজ উদ্দিন, নাজমুল ইসলাম, জয় আহমদ ও সানি আহমদ গুলিবিদ্ধ হন। তাজ উদ্দিন ও নাজমুল ইসলাম ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান। জয় ও সানি হাসপাতালে নেয়ার পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। শতশত মানুষ গুলিতে আহত হয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে আসেন। আহতদের এতোটাই চাপ ছিলো ঠিকমতো সেবা না পেয়ে সিলেটের বিভিন্ন হাসপাতালে তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয়।
অপরদিকে ঢাকাদক্ষিণে পুলিশ-বিজিবির সাথে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে কয়েকজন মারা যাওয়া ও শতশত মানুষ আহত হওয়ার খবর পাওয়ার পরও পৌর শহরের চৌমুহনীতে দেশীয় অস্ত্র-আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেয় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। কারণ,আগের দিন ৩আগস্ট ঘোষণা হয় ৪আগস্ট দুপুর ২টায় সরকারি এমসি একাডেমির সামনে থেকে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হবে। ৪আগস্ট দুপুর দুইটা। সরকারি এমসি একাডেমির সামনে থেকে স্মরণকালের সর্ববৃহৎ মিছিল বের করে ছাত্র-জনতা। হাসিনা বিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে ছাত্র-জনতার মিছিলের স্রোত পৌর শহরের চৌমুহনীর দিকে রওয়ানা হয়। তখন রাজমহলের সামনে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা উপস্থিত। চৌমুহনী গ্যাস পাম্পের সামনে থেকে ছাত্র-জনতার মিছিলটি যখন পুনরায় এমসি একাডেমির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয় থানার সামনে মিছিলটি পৌঁছামাত্র আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা তাদের ওপর হামলা চালায়। তাদের সাথে এসে যোগ দেয় পুলিশ। শুরু হয় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া৷ একসময় পুলিশ ও আওয়ামী লীগের যৌথ হামলার কাছে অসহায়ত্ব মনে হয় ছাত্র-জনতাকে। তবে এটি বেশিক্ষণ থাকেনি। উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে থেকে হাজার-হাজার ছাত্র-জনতা যখন তাজ উদ্দিনের লাশ নিয়ে চৌমুহনীতে আসেন তখন ছাত্র-জনতার ধাওয়া খেয়ে পালিয়ে যায় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা৷ এর কিছুক্ষণ পরই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান মিনহাজ আহমদ ও গৌছ উদ্দিন। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পুলিশের সাথে ছাত্র-জনতার ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলতে থাকে৷ গুলিতে একের পর একের মানুষ আহত হতে থাকেন।
এদিন ঢাকাদক্ষিণ ও পৌর শহরের চৌমুহনীতে গুলিবিদ্ধ হয়ে শতশত মানুষ আহত হয়েছেন। কেউ হারিয়েছেন চোখ, আবার কেউ এখনও শরীরের গুলি নিয়ে জীবনপাড় করছেন। অনেকে আবার সুচিকিৎসা বা সহায়তা না পাওয়ার অভিযোগ করেন।
শহীদ গৌছ উদ্দিনের ভাই আবুল কালাম বলেন, 'আমার ভাই গৌছ উদ্দিন শহিদ হয়েছে। তাকে তো আর আমরা ফিরে পাবো না। আমার ভাইসহ যারা মারা গেছেন, যারা আহত হয়েছেন আমরা এর সঠিক বিচার দাবি করছি৷'
শহিদ পাভেলের পিতা রফিক উদ্দিন৷ ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় তিনি। ছেলের কথা মনে করে সব সময় কাঁদতে থাকেন। তিনি বলেন,'আমার ছেলে খুবই ভালো ছিল। একজন কোরআনের হাফেজ। ২৮ পাড়া মুখস্থ করেছে সে। ছেলে হত্যার পর মামলা করেছি। কিন্তু এখনও ন্যায় বিচার পাইনি। আমরা প্রশাসনের কাছে ন্যায় বিচার দাবি করছি।'
ছানি আহমদের পিতা কয়ছর আহমদ বলেন,'আমাদের পরিবারের অবস্থা ভালো নয়। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিলো আমার ছেলে সানি। সে রাজমিস্ত্রীর কাজ করতো। তাকে হারিয়ে আমাদের পরিবারে হতাশা বিরাজ করছে। এখন আমাদের দাবি ৭শহিদের নামে যেন চৌমুহনীতে চত্বর নির্মাণ করা হয়। আর আসামিদের যেন আইনের আওতায় আনা হয়।'
এদিকে এ ঘটনার পর গোলাপগঞ্জ মডেল থানায় হত্যা মামলাসহ একাধিক হত্যা চেষ্টা মামলা হয়েছে। মামলার আসামি অনেকে প্রবাসে পাড়ি দিয়েছেন, অনেকে গাঁ ডাকা দিয়েছেন আবার কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তবে বর্তমানে অনেকে জামিনে রয়েছেন।
গোলাপগঞ্জ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মোল্যা বলেন,' আসামিদের আইনের আওতায় পুলিশের অভিযান অব্যহত রয়েছে। ইতিমধ্যে অনেক আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে৷ পুলিশ ছাড়াও মামলা সিআইডি ও পিবিআইতে রয়েছে৷ আশা করা যায় দ্রুত সময়ের মধ্যে মামলার চার্জশীট দেওয়া হবে।'
গোলাপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিলটন চন্দ্র পাল বলেন, ‘উপজেলা প্রশাসন সব সময় শহীদ পরিবারের পাশে আছে। তাদের আত্মত্যাগ কখনো ভূলার নয়। তাদের যে কোন প্রয়োজনে উপজেলা প্রশাসন তাদের পাশে সব সময় থাকবে।'