ট্রাম্প-মোদির সম্পর্কে ভাঙন : ভিন্ন বলয়ে কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় যা করছে ভারত

সময়টি ছিল ২০১৪ সাল। নিজের রাজ্যে বসেই চীনা প্রেসিডেন্টের সাথে বৈঠক করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তবে ঠিক ওই সময়ই সীমান্তে ভারতীয় সেনাদের সাথে সঙ্ঘর্ষ সৃষ্টি হয় চীনা সেনাদের। এর মধ্য দিয়ে শুরু হয় ভারত-চীন সম্পর্কের টানাপোড়েন। এরপর মোদিকে হিমালয়ের পাদদেশে সেনা মোতায়েন করতে হয়েছিল, যা শেষ পর্যন্ত মোদিকে অর্থনৈতিকভাবে চাপে ফেলে।
এরপরপরই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক জোরদারে মনোযোগ দেন মোদি। তিনি প্রথম মেয়াদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বড্ড ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলেন। তার গভীরতা এতটাই ছিল যে ২০১৯ সালে হিউস্টনে এক জনসভায় তিনি প্রোটোকল ভেঙে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রচারণায় অংশ নেন। বাইডেন প্রশাসনও চীনের মোকাবিলায় ভারতের সাথে সম্পর্ক বাড়াতে দলীয় বিভাজন এড়িয়ে চলেন; যে কারণে মোদি একবার সংসদে বলেই বসেছিলেন যে এআই মানে আমেরিকা-ভারত।
তবে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে এই সম্পর্ক বদলে যায়। রাশিয়া থেকে তেল কেনার অজুহাতে ভারতের উপর মোট ৫০ শতাংশ শুল্কারোপ করেন ট্রাম্প। একইসাথে তিনি ভারতের অর্থনীতিকে ‘মৃত’ বলেও অভিহিত করেন। এর বিপরীতে তিনি পাকিস্তানের নেতৃত্বের প্রতিও সমর্থন দেখান, যা ভারতের জন্য বিব্রতকর। এর ফলে বিশ্ব মঞ্চে ভারতের সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট হয় এবং নয়াদিল্লিতে ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন’-এ ফেরার আলোচনা বাড়ে।
মোদি তাই কৌশলগত সম্পর্ক নিয়ে পুনর্বিবেচনা শুরু করেন। সীমান্ত বিরোধ ও পাকিস্তানের প্রতি জোরালো সমর্থন সত্ত্বেও চীনের সাথে সম্পর্ক মেরামতে তিনি মনোযোগ দিচ্ছেন। গত সাত বছরের মধ্যে এবারই প্রথম চীন সফরের পরিকল্পনা করছেন মোদি। তিনি ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভার সাথেও সম্পর্ক পুনর্গঠন করে নিচ্ছেন। পুতিনের সাথে কথা বলেও সম্পর্ক আরো ঝালিয়ে নিলেন। তাকে ভারত সফরের নিমন্ত্রণও জানালেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্পের ৫০ শতাংশ শুল্কারোপ গত দুই দশক ধরে গড়ে ওঠা মার্কিন-ভারত অংশীদারিত্বের ভিত্তি নাড়িয়ে দিয়েছে। ভারতের অর্থনীতি কিছুটা শক্তি জুগিয়েছে। তবে সময় এসেছে সেটি নিয়ে এখন গভীর আত্মসমালোচনার। সাবেক কূটনীতিক নিরুপমা রাওয়ের মতে, নয়াদিল্লি বাস্তববাদী কৌশলগত পুনর্গঠন করবে।
ভারত-মার্কিন আনুষ্ঠানিক আলোচনা বন্ধ হয়নি। চলতি মাসের শেষে কার্যকর হওয়ার কথা থাকা অতিরিক্ত শুল্ক ট্রাম্পের এক ধরনের দর কষাকষির কৌশল বলেও মনে করা হচ্ছে। ভারত প্রতিরক্ষা ও জ্বালানি খাতে মার্কিন পণ্য কেনা বাড়াতে আগ্রহী ছিল এবং কৃষি বাজার আংশিক খোলার ইঙ্গিত দিয়েছিল।
তবে বিশ্বাসের ঘাটতি রয়ে গেছে। বিশ্লেষকদের মতে, চীনের আগ্রাসনের মতো ট্রাম্প ইস্যুতেও মোদি প্রকাশ্যে সঙ্ঘাত না বাড়িয়ে সমাধান খুঁজবেন। অক্টোবরে দুই পক্ষই সম্পর্ক পুনর্গঠনের পথে এগোয়। ট্রাম্পের ঘোষণার পর মোদি বলেন, ‘ভারত কখনই কৃষক, জেলে ও দুগ্ধচাষীদের স্বার্থে আপস করবে না… আমি ব্যক্তিগতভাবে এর জন্য মূল্য দিতে প্রস্তুত।’
কিছু পর্যবেক্ষকের মতে, সম্পর্কের অবনতি ট্রাম্পের ব্যক্তিগত মনোভাবের ফলও হতে পারে। বসন্তে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার পর ট্রাম্প যুদ্ধবিরতিতে নিজের ভূমিকা দাবি করেন, যা ভারতীয় পক্ষ প্রত্যাখ্যান করে। লেখক সঞ্জয় বারুর মতে, মোদি ও ট্রাম্প দু’জনই ব্যক্তিনির্ভর ও অহংপ্রবণ নেতৃত্বের কারণে রাষ্ট্রের সম্পর্ককে ব্যক্তিগত সম্পর্কে পরিণত করেছেন এবং এর মূল্য ভারতকে দিতে হচ্ছে।
সূত্র : নিউইয়র্ক টাইমস