ঢাকা-সিলেট সড়কে ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় আটকে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প

ঢাকা-সিলেট সড়কে ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় আটকে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প

ভূমি অধিগ্রহণ ও ইউটিলিটি লাইন সরাতে দীর্ঘ সময় লেগে যাওয়ার কারণে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক সম্প্রসারণের কাজ চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। প্রকল্প কর্তৃপক্ষ মহাসড়ক সম্প্রসারণে ঠিকাদার নিয়োগ করলেও জমি হস্তান্তর করতে না পারায় ঠিকাদাররা ক্ষতিপূরণ এবং সময় বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে।

একই পরিণতির মুখে সিলেট-তামাবিল মহাসড়ক সম্প্রসারণ প্রকল্পটিও। সেখানেও সময় ও খরচের বোঝা বাড়ছে।প্রকল্প দুটিতে প্রায় ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয় হবে।

ঢাকা-সিলেট-তামাবিল রোড এশিয়ান হাইওয়ে-১ এর একটি অংশ, যা বাংলাদেশের সঙ্গে এবং পাশাপাশি তামাবিল-সিলেট-কাঁচপুর-ঢাকা-যশোর-বেনাপোল হয়ে ভারতের মেঘালয় এবং পশ্চিমবঙ্গকে সংযুক্ত করবে বলে পরিকল্পনা রয়েছে।

পাঁচ বছর আগে জমি অধিগ্রহণে একটি পৃথক প্রকল্প করা হলেও তারা জমি হস্তান্তরে ব্যর্থ হওয়ায় সম্প্রসারণ কাজ এগোচ্ছে না।

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, জমি অধিগ্রহণ একটি জটিল প্রক্রিয়া। আরো অভিযোগ, স্থানীয় প্রশাসন কর্মকর্তাদের একাংশের আন্তরিকতার অভাবও এই প্রক্রিয়ায় দেরির জন্য দায়ী।

গত বৃহস্পতিবার সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী এই সংকট নিরসনে বৈঠকে বসেন।

জানা গেছে, এতে সাত জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা ও অন্যান্যদের উপস্থিতিতে কাজ শেষ করার জন্য বিভিন্ন সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়।

সাধারণত, জমি অধিগ্রহণ এবং ইউটিলিটি লাইন এবং পাইপ সরানোর মতো কাজগুলো অবকাঠামো সুরক্ষারই অংশ।

কিন্তু সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা-সিলেট-তামাবিল সড়ক সম্প্রসারণে ২০২০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে জমি অধিগ্রহণ ও ইউটিলিটি সার্ভিস স্থানান্তরের জন্য ৩ হাজার ৫৮৬ কোটি ৪ লাখ টাকা ব্যয়ে পৃথক প্রকল্প গ্রহণ করে।

উদ্দেশ্য ছিল এই সমস্যাগুলো দূর করা। সরকার চেয়েছিল সম্প্রসারণ প্রকল্প অনুমোদনের সাথে সাথে রাস্তাটি সম্প্রসারণ করা হবে।

জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে সিলেট-তামাবিল মহাসড়কের ৫৬ দশমিক ১৬ কিলোমিটার এলাকা চার লেনে উন্নীতকরণের জন্য ৩ হাজার ৫৮৬ কোটি ৪ লাখ টাকার প্রকল্পটি অনুমোদন করে। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে ২০২৫ সালের জুনে।

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর থেকে সিলেট পর্যন্ত ২০৯ কিলোমিটার সড়ক চার লেনে উন্নীত করতে ১৬ হাজার ৯১৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকার ঢাকা-সিলেট সম্প্রসারণ প্রকল্প অনুমোদন দেয় একনেক। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।

সম্প্রসারণ প্রকল্প এগিয়ে নিলেও ভূমি অধিগ্রহণ প্রকল্প দুই দফায় সংশোধন করে ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ৭ হাজার ৯৭৫ কোটি ৩১ লাখ টাকা এবং সময় বাড়ানো হয় ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।

প্রকল্প সূত্রগুলো জানায়, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক সম্প্রসারণের জন্য সাত জেলায় ৮২৯ দশমিক ৮৩ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য ৬৬টি ভূমি অধিগ্রহণের (এলএ) প্রস্তাব জমা দেওয়া হয়।

কিন্তু এলএর চারটি প্রস্তাবের আওতায় এখন পর্যন্ত মাত্র ৬০ একর জমির কাগজপত্র প্রকল্প কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

স্থানীয় প্রশাসন এখনও জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ না দেওয়ায় কর্তৃপক্ষ জমির নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি বলে জানান তারা।

যেহেতু এটি এডিবির অর্থায়নে প্রকল্প, সেহেতু মালিকরা পূর্ণ ক্ষতিপূরণ না পাওয়া পর্যন্ত প্রকল্প কর্তৃপক্ষ ওই জমি ব্যবহার করতে পারবে না।

ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক সম্প্রসারণের প্রকল্প পরিচালক এ কে মোহাম্মদ ফজলুল করিম বলেন, তারা ১৩টি প্যাকেজের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ দিয়েছেন।

তিনি জানান, শর্ত অনুযায়ী চুক্তি স্বাক্ষরের ২৭০ দিনের মধ্যে জমি ঠিকাদারদের কাছে হস্তান্তর করার কথা ছিল।

তিনি ফোনে বলেন, এর মধ্যে চার জন ঠিকাদার তাদের অব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও জনবলের জন্য আর্থিক ক্ষতিপূরণ চেয়েছেন এবং সময়সীমা বাড়ানোর জন্য বলেছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রকল্পের আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘দেরি হওয়ায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। সময়সীমা বাড়ালে শেষ পর্যন্ত খরচ বাড়বে।’

এক প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, তাদের ঠিকাদাররা এখন সড়ক ও জনপথের আওতাধীন জমিতে সীমিত আকারে কাজ করছে।

সিলেট-তামাবিল সড়ক সম্প্রসারণের জন্য সিলেট জেলায় ৩৩৫.৭৭ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য এরই মধ্যে ৩০টি এলএ প্রস্তাব জমা দেওয়া হয়েছে।

প্রকল্প কর্তৃপক্ষের কাছে কোনো জমি হস্তান্তর করা হয়নি বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

যোগাযোগ করা হলে প্রকল্প পরিচালক আবু সাঈদ মোঃ নাজমুল হুদা বলেন, তারা চারটি প্যাকেজের আওতায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবেন।

তিনি বলেছিলেন, ‘ইতোমধ্যে একটি প্যাকেজের জন্য চীন-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে গঠিত একটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে আর অন্য দুটি প্যাকেজের জন্য ঠিকাদার নিয়োগের প্রস্তাব দ্রুতই সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে পাঠানো হবে।’

তিনি আরো জানান, প্রতিষ্ঠানটি এরই মধ্যে তাদের সরঞ্জাম এবং জনবল সংগ্রহ করেছে এবং এক সপ্তাহের মধ্যে এরা কাজ শুরু করবে।

‘ভূমি অধিগ্রহণে দেরির কারণে শেষ পর্যন্ত এই প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় বাড়বে’, দ্যা ডেইলি স্টারকে বলছিলেন তিনি।

এই প্রকল্পগুলির সাথে জড়িত নয় সড়ক বিভাগের এমন এক কর্মকর্তা বলেছেন, জমি অধিগ্রহণ শেষ হতে এক বা দুই বছর সময় লাগতে পারে, ‘কিন্তু দুই বছরের বেশি সময় লেগে যাওয়া গ্রহণযোগ্য নয়। তাই স্থানীয় প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তার মধ্যে অবশ্যই আন্তরিকতার অভাব রয়েছে।’

বড় অবকাঠামো প্রকল্পগুলিতে এই ঘটনা নিয়মিত ঘটছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভূমি অধিগ্রহণের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ার শেষ করতে স্থানীয় প্রশাসনের জন্য একটি স্পষ্ট সময়সীমা থাকা জরুরি।

যোগাযোগ করা হলে ভূমি অধিগ্রহণ প্রকল্প পরিচালক এবং সিলেট সড়ক জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. ফজলে রব্বে গতকাল ডেইলি স্টারকে বলেন, ভূমি অধিগ্রহণ জটিল ও স্পর্শকাতর প্রক্রিয়া।

‘এতে সমস্ত প্রাসঙ্গিক আইন ও পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয় যাতে কেউ বঞ্চিত না হয়।’

প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে দেরি করছে না, কোনো পক্ষ থেকে কোনো গাফিলতি নেই, আমরা সবাই সাধ্যমত চেষ্টা করছি।’