সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়রসহ সেনা আশ্রয়ে ৪০০!

সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়রসহ সেনা আশ্রয়ে ৪০০!

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর মন্ত্রী, এমপি, আমলা, রাজনৈতিক নেতা, পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অনেকেই সেনাবাহিনীর আশ্রয়ে রয়েছেন। জনরোষ থেকে প্রাণ বাঁচাতে তারা এই আশ্রয়স্থল বেছে নিয়েছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী তাদের আশ্রয় দিয়েছে। সেই সঙ্গে অভিযুক্ত হলে তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো হবে বলে সবাইকে আশ্বস্ত করা হয়েছে। এই আশ্রিতের সংখ্যা কত এবং তারা কারা এ নিয়ে জনমনে ব্যাপক কৌতূহল রয়েছে। তবে এ বিষয়ে কিছু ধারণা পেলেও সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। 

একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ঢাকা ও মিরপুর সেনানিবাসসহ দেশের প্রত্যেকটি সেনানিবাসে কম-বেশি মানুষ ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে আশ্রয় নিয়েছেন। সেনাবাহিনী যাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে, তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপি, সাবেক মন্ত্রী ও এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান, পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা, সচিবসহ বিভিন্ন পর্যায়ের আমলা, জেলা-উপজেলা পর্যায়ের আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতা এমনকি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও রয়েছেন। এই সংখ্যা আনুমানিক ৪০০ বা তার বেশিও হতে পারে বলে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ঢাকায় এই সংখ্যা ৫০ বা তার কাছাকাছি। বিভিন্ন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। 

সেনাবাহিনী ও পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে পুলিশ বাহিনীর সক্ষমতা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। অনেক পুলিশ সদস্য কাজে যোগ না দিয়ে কর্মবিরতি শুরু করেন। ‍পুলিশের সক্ষমতা না থাকায় ‘নিরাপত্তাজনিত’ কারণে সেনা আশ্রয়ে থাকা ব্যক্তিদের একসঙ্গে ছাড়া সম্ভব হয়নি। সেটা বাস্তবসম্মত নয় বলেই মনে করা হচ্ছে। কারণ ছেড়ে দেওয়ার পর যারা নানা অপরাধে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া, জিজ্ঞাসাবাদ করা ও তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করার ওপর ‍গুরুত্ব দিয়ে তাদেরকে একের পর এক ছাড়া হচ্ছে। সকল পুলিশ সদস্য এরই মধ্যে কাজে যোগ দিয়েছেন। সক্ষমতা বাড়তে থাকায় সেনাবাহিনীর কাছে আশ্রয় নেওয়া বেশ কয়েকজনকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা, রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদসহ প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। 

বিগত সরকারের মন্ত্রী, এমপি, জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকের সেনাবাহিনীর আশ্রয়ে থাকার বিষয়টি জানিয়েছে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানও। গত ১৩ আগস্ট এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, জীবন বিপন্ন হতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অনেককেই সেনাবাহিনী আশ্রয় দিয়েছে। তাদের প্রতি যদি কোনো অভিযোগ থাকে, মামলা হয় তাহলে তারা শাস্তির আওতায় যাবেন। কিন্তু অবশ্যই আমরা চাইব না যে, বিচারবহির্ভূত কোনো কাজ বা তাদের ওপর হামলা হোক। তাদের জীবনের হুমকি আছে, সেটার জন্য আমরা তাদের আশ্রয় দিয়েছি। সে যে দলেরই হোক, যে মতেরই হোক, যে ধর্মের হোক, সেটা (নিরাপত্তা) আমরা দেখব। 

প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা ভারতে চলে যাওয়ার পরপরই ৫ আগস্ট হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ৬ ঘণ্টা বন্ধ রাখার কথা জানায় আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। ফলে যারা পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তাদের অনেকেই তখন চেষ্টা করেও তা পারেনি। এমনকি পরের দিনগুলোতে পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে তাদের কেউ কেউ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরাও পড়েছেন। 

৬ আগস্ট সকালে পুলিশ সদর দপ্তরের এক বার্তায় স্পেশাল ব্রাঞ্চের ইমিগ্রেশন শাখা জানায়, ‘দেশের সকল ইমিগ্রেশন পোস্টে কার্যক্রম চলমান রয়েছে। প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ না করায় অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে পরামর্শক্রমে বিভিন্ন হাই প্রোফাইল ব্যক্তিবর্গ যেমন সাবেক মন্ত্রী, এমপি, রাজনৈতিক নেতা, সরকারি কর্মকর্তা, মিডিয়াকর্মীদের ইমিগ্রেশন সম্পন্ন না করে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’ 

গোয়েন্দা সংস্থা সূত্র জানায়, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, এমপি, পুলিশ কর্মকর্তা বিমানবন্দর ও স্থলবন্দর দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। ইমিগ্রেশন থেকে তাদেরকে সেনাবাহিনীর আশ্রয়ে নেওয়া হয়। এ ছাড়া বেশ কয়েকজন নিরাপত্তার স্বার্থে নিজেরাই আশ্রয় চাইলে তাদেরকে সেনাবাহিনীর আশ্রয়ে নেওয়া হয়েছে।

৫ আগস্ট ‍পুলিশের তৎকালীন আইজি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন ও ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান সেনানিবাসে আশ্রয় নেন। পরে এসবির প্রধান মনিরুল ইসলাম ও ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারকেও সেনাবাহিনীর আশ্রয়ে নেওয়া হয়। বিপ্লব কুমার বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। ওই সময় তাকে আটক করা হয়। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ লাপাত্তা। 

হারুন ও বিপ্লবের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার মো. মাইনুল হাসান বলেন, ‘তারা এখনও কাজে যোগ দেননি। আর তাদের বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা। এ ছাড়া ডিএমপির প্রায় সকল সদস্য কাজে যোগ দিয়েছেন। তারা নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করছেন।’ 

শেখ হাসিনা ভারতে চলে যাওয়ার পরপরই বিমানবন্দর দিয়ে তার সরকারের মন্ত্রিসভার বেশ কয়েকজন সদস্য দেশত্যাগের চেষ্টা করেন। ৬ আগস্ট সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককে বিমানবন্দর ইমিগ্রেশন ফিরিয়ে দেওয়ার পর সেনাবাহিনীর আশ্রয়ে নেওয়া হয়। গত বুধবার পলক ও সদ্যবিলুপ্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু এবং ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতকে গ্রেফতার দেখায় পুলিশ। 

বিমানবন্দরে পলক আটক হওয়ার কিছুক্ষণ পর আটক হন দুর্নীতিসহ নানা কারণে আলোচিত সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। ইমিগ্রেশন পুলিশ তাকে আটকে দেয়। পরে বিমানবন্দর সূত্র হাছান মাহমুদ ও পলককে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে। গত শুক্রবার চট্টগ্রামের সাবেক সংসদ সদস্য এম এ লতিফ বিএনপি নেতাকর্মীদের তোপের মুখে পড়ার পর তাকে সেনাবাহিনীর আশ্রয়ে নেওয়া হয়। শনিবার আদালতে হাজির করে তাকে ৩ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। 

গত ৭ আগস্ট মধ্যরাতে বিমানবন্দরে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে তল্লাশি চালিয়ে আটক করা হয় সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অব্যাহতি পাওয়া মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানকে। ১৬ আগস্ট শুক্রবার তাকে আদালতে হাজির করে ৮ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। ওই দিন সন্ধ্যায় ডিএমপি এক বার্তায় জানায়, ‘এনটিএমসি’র সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান (অব.) ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় সেনাবাহিনীর আশ্রয় গ্রহণ করেন। ১৫ আগস্ট দিবাগত রাতে সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাকে পুলিশের নিকট হস্তান্তর করেন। এর প্রেক্ষিতে তাকে গ্রেফতার করা হয়।’ 

অন্যদিকে ১৩ আগস্ট সন্ধ্যায় নৌপথে পালানোর সময় রাজধানীর সদরঘাট এলাকা থেকে পুলিশ সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে গ্রেফতার করে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে নিউমার্কেট এলাকার একটি হত্যা মামলায় তাদেরকে বর্তমানে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

এ ছাড়া সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীসহ আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা রয়েছেন সিলেট সেনানিবাসে। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও যশোর সেনানিবাসেও অনেকে আশ্রয় নিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। তবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন সেনা আশ্রয়ে আছেন কিনা জানতে চাইলে ঢাকা সেনানিবাসের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা এই ‍দুজন সেনা আশ্রয়ে নেই বলে জানান। তারা অন্য কোথাও আত্মগোপনে আছেন বলে মনে করা হচ্ছে। 

সেনাবাহিনীর আশ্রয়ে থাকা ব্যক্তিদের বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, যিনি বর্তমানে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ‘যাদের অপরাধের সম্পৃক্ততা আছে এবং আত্মগোপনে আছেন তাদেরকে আমরা খুঁজছি। পুলিশ তাদের মতো করে চেষ্টা করছে।’

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘সেনা হেফাজতে যারা আছে তার একটা তালিকা করা দরকার। এসব ব্যক্তিকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। তারা যাতে পালিয়ে যেতে না পারে সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।’

সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) বায়েজিদ সারোয়ার সাংবাদিকদের বলেন, ‘নিজেদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে, জীবন বিপন্ন হতে পারে এমন শঙ্কা থেকেই মন্ত্রী, এমপি ও আমলাদের অনেকেই সেনাবাহিনীর কাছে আশ্রয় চেয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে আদালতে নিয়মিত মামলা হলে এবং সেনা কর্তৃপক্ষকে জানালে তখন পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতারে বাধা থাকবে না।’ সুত্র : প্রতিদিনের বাংলাদেশ