সিলেট ও সুনামগঞ্জে পানি নামছে ধীরগতিতে, ভেসে উঠছে বন্যার ক্ষত
বন্যার পানির তোড়ে মেঝের মাটি দেবে গেছে। ঘরের কয়েকটা খুঁটি যেন শূন্যে ঝুলছে। সেটি দেখাতে গিয়ে চোখ ভিজে আসে জাবেদ হোসেনের (২৭)। তিনি বলেন, ‘আমি সিএনজিচালক। পরের গাড়ি চালাই। গত বছর ঋণ করি টিনের ঘর বানাইছি। ঋণের টাকা শোধও অইছে না। এখন বানের পানি ঘরে ধস নামাইছে। এই ঘর এখন ক্যামনে মেরামত করমু, এই নিয়া চউখে আন্ধাইর দেখতাছি।’
জাবেদের বাড়ি সিলেট সদর উপজেলার কান্দিগাঁও ইউনিয়নের জাঙ্গাইল গ্রামে। গত সোমবার থেকে শুরু হওয়া বন্যায় জাবেদের ঘরও প্লাবিত হয়। সেদিনই মা, স্ত্রী আর দুই সন্তানকে নিয়ে পাশের আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নেন। চার দিন সেখানে কাটিয়ে গতকাল শুক্রবার বাড়ি ফেরেন তাঁরা। এখন বিধ্বস্ত ঘরে আতঙ্ক নিয়ে থাকতে হবে বলে জানালেন জাবেদ।
দুই দিন ধরে সিলেট ও সুনামগঞ্জে বৃষ্টি হচ্ছে না। ধীরগতিতে হলেও পানি নামতে শুরু করেছে। সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। তবে পানিবন্দী কয়েক লাখ মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। দিন যতই যাচ্ছে, ভোগান্তি ততই বাড়ছে।
সিলেট শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে জাঙ্গাইল গ্রাম। প্রায় তিন'শ পরিবারের বাস এ গ্রামে। গ্রামটির দেড়'শ বাড়িই প্লাবিত হয়েছে। হাঁটু থেকে কোমর পর্যন্ত পানি ছিল। গতকাল অনেক জায়গা থেকে পানি নেমে যাওয়ায় বন্যার ক্ষত দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে।
নদীর ঠিক পারেই ষাটোর্ধ্ব দিনমজুর গোলাম মোস্তফার বাড়ি। উঠানে থাকা গোড়ালিসমান থিকথিকে কাদা মাড়িয়ে তাঁর ঘরে পৌঁছে একই চিত্র দেখা গেল। মোস্তফার স্ত্রী মমতা বেগম (৪৮) তখন ঘরের কাদা সরাচ্ছিলেন। এই কদিনে বানের পানিতে চলতে গিয়ে তাঁর হাতে-পায়ে ঘা হয়ে গেছে। তা দেখিয়ে মমতা বলেন, ‘ঘা হইলেও কী হইব? ঘর তো ঠিক করতে হইব। মাটি লেপ দিয়া ঠিক করতাছি ঘর। সব শ্যাষ অই গেছে। বেড়া ভাঙি গেছে। ঘরে খাওন নাই। আশ্রয়কেন্দ্রে কিছু চিড়া, গুড় পাইছিলাম। আর কুনু ত্রাণ পাইছি না।’
গতকাল দুপুরে সিলেট নগরে সরেজমিনে দেখা গেছে, অনেক এলাকা থেকে পানি নেমে গেছে। তবে ১০ থেকে ১২টি এলাকায় এখনো পানি আছে। নগরের টুকেরবাজার এলাকার সবজির বাজার এখনো পানিতে তলিয়ে আছে। উপশহর ও সোবহানীঘাট এলাকার অনেক রাস্তা ও বাসাবাড়ি এখনো পানির নিচে। বিভিন্ন এলাকার পানি নেমে যাওয়ায় মানুষজন বাসাবাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করছেন। কোথাও কোথাও জমে থাকা পানি থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
প্রতিমন্ত্রীর আশ্বাস
গতকাল সকালে সিলেট নগরের কিনব্রিজ এলাকায় সুরমা নদীর পানি দেখতে গিয়ে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক সিলেট ও সুনামগঞ্জের ছোট–বড় ২০টি নদ-নদী খনন করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন। এ সময় তিনি বলেন, সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যাকবলিত এলাকা কীভাবে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা যায়, সে লক্ষ্যে আলোচনা চলছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সর্বশেষ তথ্য অনুযাযী, গতকাল সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত জেলার প্রধান দুটি নদী সুরমা ও কুশিয়ারার পাঁচটি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। তবে সব কটি নদ-নদীর পানি কমেছে।
গত দুই দিনে বন্যার পানিতে ডুবে আরও তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে বন্যার পানিতে ডুবে, স্রোতে ভেসে গিয়ে ও বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে আটজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেল। গতকাল বেলা একটার দিকে সিলেট নগরের শাহপরান এলাকার একটি খালের পানিতে গোসল করতে নেমে ডুবে মারা যায় অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া অভি (১৭)। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে ও সন্ধ্যায় জৈন্তাপুর উপজেলার করগ্রাম ও বারিইকান্দি গ্রামে পৃথক দুটি ঘটনায় বন্যার পানিতে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। নিহতেরা হচ্ছে ডইয়া গ্রামের বিলাল আহমদের আড়াই বছরের ছেলে হাবিবুর রহমান এবং বারইকান্দি গ্রামের রফিকুল ইসলামের দেড় বছরের মেয়ে মানহা আনজুম।
দুশ্চিন্তায় সুনামগঞ্জের মানুষ
গতকাল দুপুরে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা থেকে চার কিলোমিটার দূরে হাসনবসত গ্রামে গিয়ে কথা হয় আবদুল কুদ্দুসের (৬০) সঙ্গে। ঈদের দিন থেকে বাড়িছাড়া আবদুল কুদ্দুস। ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট সবই বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে এলাকার একটি নির্মাণাধীন ভবনে আশ্রয় নিয়েছেন। থাকা-খাওয়ার চরম কষ্টে দিন কাটছে তাঁদের। কুদ্দুস বললেন, ‘কামকাজ নাই। খেয়ে না খেয়ে দিন যাচ্ছে। কেউ কোনো সাহায্য করছে না। বড় কষ্টে আছি।’
একই গ্রামের দীন ইসলাম জানালেন, তিনি স্ত্রী, ছেলেমেয়ে নিয়ে উপজেলা পরিষদে আশ্রয় নিয়েছেন। যেভাবে পানি নামছে, তাতে আরও তিন-চার দিন লাগবে ঘর থেকে পানি নামতে। দীন ইসলাম বলেন, ‘পানিতে ঘরের বেড়া, আসবাবের ক্ষতি হয়েছে। হাত খালি, কীভাবে ঘরের কাজ করব, এই চিন্তায় আছি।’
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী বিতরণের কথা বলা হলেও অনেক জায়গায় বন্যার্তরা ত্রাণ পাননি বলে জানিয়েছেন। তবে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বলেছেন, পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী আছে। বিতরণও হচ্ছে।
সুনামগঞ্জে ১৬ জুন থেকে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। অসংখ্য ঘরবাড়ি, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও রাস্তাঘাট প্লাবিত হয়েছে। ভেসে গেছে পুকুর ও খামারের মাছ। শুরুর দিকে সদর, ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলা আক্রান্ত হলেও পরে জেলার সব উপজেলা বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে। ছয় দিন ধরে মানুষ দুর্ভোগে আছেন। এখনো জেলা সদরের সঙ্গে তাহিরপুর, ছাতক, দোয়ারাবাজার উপজেলায় সরাসরি যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।
সুনামগঞ্জ শহরে এখনো অনেক মানুষের বসতঘরে পানি আছে। এই মানুষজন আছে বেশি কষ্টে। অনেকেই ঠাঁই নিয়েছেন আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে। কেউবা পরিবার নিয়ে উঠেছেন আবাসিক হোটেলে। আবার কেউ কেউ আছেন আশ্রয়কেন্দ্রে।
পাউবো সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন হাওলাদার বলেন, পানি কমছে। বৃহস্পতিবার থেকে সুনামগঞ্জে তেমন বৃষ্টি হয়নি। এ সময় উজানের পাহাড়ি ঢল নেমেছে কম। নদীর পানি আরও কমবে।