সিলেটে সড়কে বেড়েই চলেছে মৃত্যুর মিছিল

সিলেটে সড়কে বেড়েই চলেছে মৃত্যুর মিছিল

দায় নিতে চান না কেউ। সড়কে মৃত্যুর মিছিল কমানোরও কোনো তাগিদ নেই। নির্বিকার সবাই। আর ওদিকে সড়কে ঝরছে একের পর এক প্রাণ। এনিয়ে ক্ষোভের অন্ত নেই সিলেট। দুর্ঘটনা হলে ক্ষুব্ধ জনতা রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়। প্রশাসনের আশ্বাসে পরে ছেড়েও দেয়। কিন্তু কার্যত কিছুই হয় না। সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া কয়েকটি দুর্ঘটনা সিলেটবাসীকে নাড়িয়ে দিয়েছে। এনিয়ে প্রশাসনের ভেতরে চলছে একে অপরের প্রতি অভিযোগ।

কেউ কোনো দায়িত্ব নিতে চান না। গা-বাঁচিয়ে চলছে সবাই। নিরাপদ সড়ক চাই, নিচসা’র পক্ষ  থেকে সিলেটে প্রতি মাসে সড়ক দুঘর্টনায় নিহত ও আহতদের পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়। সে হিসাবে দেখা গেছে; গত জানুয়ারি মাস থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত সিলেটে সড়ক দুর্ঘটনায় ১৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহতের সংখ্যা আড়াইশ’র উপরে। এরমধ্যে সর্বশেষ এপ্রিল মাসে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৪০ জনের। গতকাল সিলেট নগরের অদূরে বিমানবন্দর এলাকার ধোপাগুলের লালবাগে ট্রাক ও সিএনজি অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে ২ যাত্রীর প্রাণ গেছে। একইদিনে হবিগঞ্জে আরও একটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। ওই দুর্ঘটনায়ও ২ জন মারা গেছেন। এর আগে রোববার রাতে জকিগঞ্জের সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনাটি ছিল মর্মান্তিক।

বাড়ি ফেরার পথে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ট্রাক্টরের সঙ্গে সংঘর্ষে ৩ যুবক মারা গেছেন। এ ঘটনায় শোক বিরাজ করছে সিলেটের জকিগঞ্জে। সিলেট-তামাবিল, সিলেট-ভোলাগঞ্জ ও সিলেট-জকিগঞ্জ সড়কে সবচেয়ে বেশি ঘটছে দুর্ঘটনা।

সিলেট তামাবিল সড়কে দুর্ঘটনা ঘটার কারণ হিসেবে এলাকাবাসী জানিয়েছেন, বেপরোয়া গতির গাড়ির কারণে ওই সড়কে মৃত্যুর মিছিল চলে। বিশেষ করে চোরাকারবারি পণ্য বহনকারী ট্রাক, পিকআপের দ্রুতগতির কারণে প্রায়ই ঘটে দুর্ঘটনা। ওই সড়কের দানব গাড়ি বলা হয় ডিআই ও ইএক্স পিকআপ। পরপর কয়েকটি দুর্ঘটনায় অন্তত ২০ জন মানুষের প্রাণ গেছে। গেল মাসে সিলেটের দরবস্ত এলাকায় পিকআপের সঙ্গে লেগুনার সংঘর্ষে পাত্র সম্প্রাদায়ের একই পরিবারের ৪ জনসহ ৬ জন মারা যান।

এর আগে পিকআপের চাপায় আলু বাগান এলাকায় ৩ যুবকের মৃত্যু হয়। ট্রাকের ধাক্কায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ৪ নম্বর এলাকায় নদীতে প্রাইভেটকার পড়ে মারা যায় চার যুবক। এ ঘটনায় আহতদের চিকিৎসা প্রদানকে কেন্দ্র করে জৈন্তাপুর হাসপাতালে ভাঙচুর করা হয়েছিল। এলাকাবাসী সচেতন হওয়ায় গত ১৫ দিন ধরে ওই সড়কে চোরাকারবারি গাড়ির তাণ্ডব কিছুটা কমেছে। ডিআই ও ইএক্স পিকআপ, তিন চাকার টমটম, রিকশা ও বেপরোয়াগতিতে গাড়ি চালনার কারণে ওই সড়কে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী। এনিয়ে তারা গত মাসে প্রশাসনকে আল্টিমেটামও দিয়েছিলেন। সিলেট-ভোলাগঞ্জ সড়কে প্রায়ই ঘটে দুঘর্টনা। 

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, প্রতিটি দুর্ঘটনার পেছনে রয়েছে পাথরবাহী ট্রাক। কোম্পানীগঞ্জ, ভোলাগঞ্জ, ধোপাগুলসহ কয়েকটি এলাকায় প্রতিদিন শত শত ট্রাক চলছে। আর ট্রাকের সঙ্গে ঘটছে দুর্ঘটনা। সিলেট-জকিগঞ্জ সড়কে ট্রাক্টরসহ অবৈধ যানবাহনের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। নিরাপদ সড়ক চাই নিসচার’র কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিলেটের আহ্বায়ক জহিরুল ইসলাম মিশু জানিয়েছেন, সড়ক দুর্ঘটনা সিলেটে বেড়ে চলার অন্যতম কারণ হচ্ছে আইন মেনে না চলা। 

পরিসংখ্যান দিয়ে তিনি বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় হালকা যানবাহন চালকদের। মার্চ পর্যন্ত সিলেটের সড়কে ৩৬ জন মোটরসাইকেল ও ২৪ জন সিএনজি অটোরিকশা চালকের মৃত্যু হয়েছে। 

এতে দেখা গেছে, ৬০ ভাগ দুর্ঘটনা হয়েছে মুখোমুখি সংঘর্ষে। অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলাচলের কারণে ঘটছে দুর্ঘটনা। এতে প্রশাসনের ভূমিকা ততটা পরিলক্ষিত হয় না। আইন প্রয়োগ সীমিত থাকার কারণে অদক্ষতার কারণে ঘটে দুর্ঘটনা। তিনি বলেন, বর্তমানে দেখা যাচ্ছে সিলেটের সড়কেই বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। এনিয়ে সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই বলে জানান তিনি। 

এদিকে সিলেটে মোটরসাইকেল ও সিএনজি অটোরিকশার দুর্ঘটনায় দেখা গেছে বেশির ভাগেরই বৈধতা ছিল না। আবার চালকদেরও ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। কারও কারও ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকলেও অদক্ষতার কারণে ঘটছে দুর্ঘটনা। 

অভিযোগ উঠেছে বিআরটিএ থেকে টাকার বিনিময়ে লাইসেন্স নিয়ে অনেকেই যানবাহন নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন। এটিও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলে জানিয়েছেন পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা। 

তবে সিলেট জেলা বিআরটিএ’র সহকারী পরিচালক (ইঞ্জি.) রিয়াজুল ইসলাম এ অভিযোগটি মানতে নারাজ। তার মতে, সিলেট বিআরটিএ দক্ষতা দেখেই চালকদের লাইসেন্স দিয়ে থাকে। সড়কে অবৈধ যানবাহন চলাচল ঠেকাতে অভিযানও পরিচালনা করে। যেসব সড়কে অবৈধ যানবাহন ও লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালায় তাদের বিরুদ্ধে যারা সার্বক্ষণিক দায়িত্বে থাকেন তাদের ভূমিকা রাখার কথা বলেন তিনি।

সড়কে দুর্ঘটনা কমাতে স্থানীয়ভাবে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করেন সিলেট হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. শহীদুল্লাহ। তিনি বলেন, পুলিশ সচেতনতা অভিযান করে, কিন্তু জনগণ সচেতন হয় না। সিলেটে প্রায় ২১৫ কিলোমিটার হাইওয়ে সড়ক রয়েছে। স্বল্পসংখ্যক লোকবল দিয়ে পুলিশ দায়িত্ব পালন করছে। কিন্তু ওই হাইওয়ে সড়কের সঙ্গে ২৮৮টি লিংক রোড রয়েছে। ওই রুটগুলো দিয়ে অবৈধ যানবাহন হাইওয়েতে প্রবেশ করে। এতে রোডে একসঙ্গে নজরদারি দেয়া কষ্টকর হয়। এরপরও পুলিশ সেবা দিয়ে যাচ্ছে বলে জানান তিনি। দূরপাল্লার যানবাহন চালকরা পর্যাপ্ত বিশ্রাম না নিয়েই সড়কে গাড়ি চালান। এতে দুর্ঘটনা ঘটে। এজন্য চালকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো হচ্ছে বলে জানান তিনি।