যুক্তরাজ্যের রাজনীতির মোড় কি ঘুরিয়ে দিতে পারবেন ফিলিস্তিনপন্থী পাঁচ স্বতন্ত্র এমপি

যুক্তরাজ্যের রাজনীতির মোড় কি ঘুরিয়ে দিতে পারবেন ফিলিস্তিনপন্থী পাঁচ স্বতন্ত্র এমপি

যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে ব্যাপক সাফল্য পাওয়ার এক বছর পেরোতেই স্বতন্ত্র পার্লামেন্ট সদস্যরা (এমপি) যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে তাঁদের অবস্থান শক্তপোক্ত করেছেন। গাজায় চলমান যুদ্ধে ভূমিকা ও দেশের অভ্যন্তরীণ নীতি নিয়ে সরকারকে জবাবদিহির মুখে ফেলছেন তাঁরা।

এক বছর আগে নির্বাচনের রাতে কিয়ার স্টারমারের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টি বড় জয় পায়। তাদের এ বিশাল বিজয় যুক্তরাজ্যের স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোকে অবাক করেনি। কারণ, এটা প্রত্যাশিতই ছিল।

তবে নির্বাচনে যে বিষয়টি অনেককেই চমকে দিয়েছিল, তা হলো নাইজেল ফারাজের রিফর্ম ইউকে পার্টির সাফল্য। দলটি থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পাঁচজন এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। নির্বাচনের আগে রেডিও, টেলিভিশনের টক শো আর পডকাস্টে রিফর্ম ইউকে নামের এই অভিবাসনবিরোধী দলটির সম্ভাবনা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছিল। তাদের সাফল্যে কেউ কেউ নিজেদের পূর্বাভাস সঠিক বলে প্রমাণ করতে পেরেছেন, আবার অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন।

এরপর আসা যাক গ্রিন পার্টির কথায়। তারা নির্বাচনে আশাতীত ভালো করেছে। বেশির ভাগ জনমত জরিপে যে ধরনের আভাস দেওয়া হয়েছিল, তার চেয়ে বেশি সাফল্য পেয়েছে তারা। দলটি এবার চারটি আসনে জিতেছে, যা তাদের ইতিহাসে নজিরবিহীন। আগে তারা একটি আসনে জয়ী হয়েছিল।

তবে নির্বাচনী রাতের সবচেয়ে বড় চমক ছিল পাঁচজন ফিলিস্তিনপন্থী স্বতন্ত্র প্রার্থীর জয়ের বিষয়টি। মূলধারার কোনো গণমাধ্যমই এই ফলাফল আগেভাগে আঁচ করতে পারেনি। কোনো জরিপেও এসব জয়ের ব্যাপারে পূর্বাভাস ছিল না।

লেবার পার্টির যেসব এমপি নির্বাচনে তাঁদের আসন হারিয়েছেন, তাঁরা যেন হতবিহ্বল হয়ে পড়েন।

কয়েক মাস পর এই স্বতন্ত্র এমপিরা একত্র হয়ে পার্লামেন্টে ‘ইনডিপেনডেন্ট অ্যালায়েন্স’ নামে একটি জোট গঠন করেন। এখন এক বছর পর এসে তাঁরা সত্যিকার অর্থে পার্লামেন্টে তাঁদের অবস্থান শক্ত করেছেন।

জোটটির এমপির সংখ্যা রিফর্ম ইউকে পার্টির সমান। তাঁরা লেবার পার্টির পেছনের কাতারে থাকা অনেক সদস্য, গ্রিন পার্টি ও কিছু লিবারেল ডেমোক্র্যাট এমপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন।

স্বতন্ত্র এমপিরা দেশের নানা গুরুত্বপূর্ণ ও বিতর্কিত রাজনৈতিক ইস্যুতে সরকারবিরোধী অবস্থান নিয়ে সরব হয়ে উঠছেন। বিশেষ করে তাঁরা গাজায় ইসরায়েলি যুদ্ধ–সংক্রান্ত সংসদীয় আলোচনার বিষয়বস্তু এবং গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে বড় ভূমিকা রেখেছেন।

এখন আশা করা হচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটবে। স্বতন্ত্র এমপিদের পাশাপাশি লেবার পার্টি থেকে বের হয়ে আসা সদস্যদের নিয়ে দলটি গঠন করা হবে।

গত বৃহস্পতিবার লেবার এমপি জারা সুলতানা লেবার পার্টি থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। লেবার নেতা ও স্বতন্ত্র এমপি জেরেমি করবিনের সঙ্গে মিলে নতুন একটি দলের নেতৃত্ব দেবেন তিনি।
সুলতানা বলেছেন, স্টারমার সরকার গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলকে সহযোগিতা করায় তিনি লেবার পার্টি ছেড়েছেন। তাঁর অভিযোগ, এই সরকার সরাসরি গণহত্যায় যুক্ত।

অন্য চার স্বতন্ত্র এমপি নতুন দলের সঙ্গে থাকবেন কি না, তা এখনো বলেননি।

রিফর্ম পার্টি দ্রুত জনপ্রিয়তা পাওয়ার মধ্যেই এই স্বতন্ত্র এমপিরা পুরোনো দ্বিদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার শেষের শুরু করছেন এবং ব্রিটিশ রাজনীতিকে নতুনভাবে গড়ে তুলছেন।

একটি রাজনৈতিক ভূমিকম্প
মিডল ইস্ট আইয়ের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের নির্বাচনে যে ২০টি আসনে মুসলিমদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল, সেসব জায়গায় লেবার পার্টির ভোট ১৫ থেকে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। এই ভোট কমার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ ছিল গাজায় ইসরায়েলি হামলায় লেবার পার্টির প্রকাশ্য সমর্থন। সরকারের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষোভ শুধু মুসলিমদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। একই সময়ে স্বতন্ত্র এমপিরাও প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে গেছেন। তাঁরা তাঁদের প্রচারে মূলধারার রাজনীতির প্রতি সাধারণ মানুষের বিরক্তি এবং কনজারভেটিভ ও লেবার পার্টির অভ্যন্তরীণ নীতির বিরোধিতার বিষয়গুলোকে সামনে নিয়ে এসেছেন।

স্বতন্ত্র প্রার্থী শওকত আদম লেস্টার সাউথ আসনে লেবার পার্টির শ্যাডো মন্ত্রী জনাথন অ্যাশওয়ার্থকে হারিয়ে বড় চমক দেন। অথচ এটি একসময় লেবার পার্টির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল। নির্বাচনের আগে এক জনপ্রিয় পর্তুগিজ ক্যাফেতে প্রচার চালাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা এমন এক দুনিয়ায় বাস করছি, যেখানে মানুষকে ভাগ করার চেষ্টা হয়। তাই একসঙ্গে থাকা ও কাজ করাই এখন সবচেয়ে জরুরি।’

নির্বাচনে জয়ের পর দেওয়া বক্তৃতায় চক্ষুরোগ–বিশেষজ্ঞ আদম এক হাতে ফিলিস্তিনি কেফিয়েহ তুলে বলেছিলেন, এই জয় গাজার মানুষের জন্য।

উত্তর-পশ্চিম ইংল্যান্ডের পুরোনো শিল্পশহর ব্ল্যাকবার্নে আইনজীবী আদনান হুসেইন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। এ আসন ১৯৫৫ সাল থেকে টানা ৬৯ বছর ধরে লেবার পার্টির দখলে ছিল। হুসেইনের রাজনীতিতে আগমন যেন পুরো চিত্রটাই বদলে দেয়।

আদনানকে একদল সাবেক লেবার কাউন্সিলর সমর্থন দিয়ে গেছেন। গাজা ইস্যুতে লেবার পার্টির অবস্থানে ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁরা দল ছেড়েছিলেন।

প্রচার চলাকালে মিডল ইস্ট আইকে আদনান বলেন, ‘আমি এই এলাকাতেই বড় হয়েছি। আমি এখানকার মানুষের ভাষা বুঝি, তাদের সংগ্রাম জানি। গাজা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, আর এটাই আমার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার বড় কারণ। কিন্তু দারিদ্র্যও অনেক বড় সমস্যা, ঠিক তেমনি স্বাস্থ্যসেবাও।’

নির্বাচনে ওয়েস্ট ইয়র্কশায়ারের ডিউসবুরি ও ব্যাটলি আসনে ইকবাল মোহাম্মদ বড় জয় পান। তিনি লেবার প্রার্থীর চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন। ডিউসবুরিতেই ইকবালের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। পেশায় তিনি একজন প্রকৌশলী এবং আইটি পরামর্শক। একসময় লেবার পার্টির সদস্য ছিলেন। তবে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরায়েলে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের হামলার পর দলনেতা কিয়ার স্টারমার ইসরায়েলের যুদ্ধকে সমর্থন জানালে তিনি লেবার পার্টি ছেড়ে দেন।

নির্বাচনে ওয়েস্ট মিডল্যান্ডসের বার্মিংহাম পেরি বার আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আইয়ুব খান দীর্ঘদিনের লেবার এমপি খালিদ মাহমুদকে হারিয়ে দেন। আইয়ুব খান পেশায় একজন ব্যারিস্টার ও স্থানীয় কাউন্সিলর। তিনি ২০২৪ সালের মে মাসে লিবারেল ডেমোক্র্যাট পার্টি থেকে পদত্যাগ করেন। এর কারণ সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ‘তারা আমাকে গাজা নিয়ে কথা বলতে বাধা দিতে চেয়েছিল।’

আইয়ুব খান শুধু গাজা ইস্যু নয়, বরং জীবনযাত্রার খরচ, অপরাধ ও বেকারত্বের মতো স্থানীয় সমস্যাগুলো নিয়েও জোরালো প্রচার চালিয়েছেন।

এই চারজন স্বতন্ত্র এমপির তেমন কোনো পরিচিতি ছিল না। তাঁরা কোনো প্রতিষ্ঠিত দলের সদস্য ছিলেন না। তবে এই চারজনের চেয়ে ফিলিস্তিনপন্থী স্বতন্ত্র এমপি জেরেমি করবিন আলাদা। তিনি বেশ পরিচিত মানুষ। করবিন এর আগের নির্বাচনে ছিলেন লেবার পার্টির নেতা। তবে এবারের নির্বাচনে পার্টি তাঁকে প্রার্থী হতে দেয়নি, বরং তিনি প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিলে তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।

তবু আইয়ুব নিজের পুরোনো আসন ইসলিংটন নর্থ থেকে প্রায় ৫০ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হন। লন্ডনের এ আসন থেকে তিনি চার দশকের বেশি সময় ধরে প্রতিনিধিত্ব করে আসছেন।

নির্বাচনের পর মিডল ইস্ট আইকে বামপন্থী নেতা ও আজীবন ফিলিস্তিনপন্থী কর্মী জেরেমি করবিন বলেছিলেন, এই নির্বাচনে ব্যালটপেপারে ছিল ফিলিস্তিন।

নির্বাচনের কয়েক দিন পর ৮ জুলাই এই পাঁচজন স্বতন্ত্র এমপি প্রথমবারের মতো একসঙ্গে দেখা করেন। সেই বৈঠকেই স্পষ্ট হয়ে যায়, তাঁরা ভবিষ্যতে একসঙ্গে কাজ করবেন।

নতুন রাজনৈতিক দল
আশা করা হচ্ছে, করবিন ও সুলতানার নেতৃত্বে নতুন দলটি আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ঘোষণা করা হবে।

করবিন মিডল ইস্ট আইকে বলেছেন, ‘আমি আশা করি, পরবর্তী নির্বাচনে সমতা, টেকসই উন্নয়ন এবং শান্তির জন্য একটি ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠস্বর থাকবে।’

ধারণা করা হচ্ছে, নতুন দলে প্রায় ১২ জন এমপি থাকছেন। এর মধ্যে লেবার পার্টি থেকে বের হয়ে আসা কয়েকজন এমপিও আছেন। এর মধ্য দিয়ে পার্লামেন্টে তাঁদের একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি হবে, যা স্টারমার সরকারের জন্য বড় সমস্যা তৈরি করবে। এই গুরুত্বপূর্ণ ও অভূতপূর্ব পরিবর্তন ব্রিটিশ রাজনীতির চেহারা পাল্টে দিতে পারে। গাজা যুদ্ধে সমর্থনের কারণে লেবার পার্টির বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া অসন্তোষ এর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে একটি।

এক বছর আগে অনেক বিশ্লেষক ভেবেছিলেন, স্বতন্ত্ররা রাজনীতিতে তেমন একটা বড় প্রভাব ফেলবেন না। অথচ তাঁরা ব্রিটিশ রাজনীতিতে নতুন গতি নিয়ে এসেছেন।

এমন অবস্থায় পুরোনো দুই দলের অবস্থান দুর্বল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বতন্ত্র এমপিরা আগামী দিনে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠতে পারেন।

তথ্যসূত্র: মিডল ইস্ট আই