ভূমধ্যসাগর দিয়ে ইউরোপ যাওয়ার তালিকায় শীর্ষে বাংলাদেশ
থামছেই না সাগর পথে ইউরোপে মানবপাচার। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ পৌঁছানোর তালিকায় শীর্ষে বাংলাদেশ। চলতি ক্যালেন্ডারের প্রথম ৪ মাসে এই ঝুঁকিপূর্ণ পথে যত মানুষ ইউরোপ ঢুকেছে তার ২১ শতাংশই বাংলাদেশি। আর অবৈধ পথে ইউরোপ পাড়ি দিতে গিয়ে মৃতের তালিকার ১২ ভাগ। গত পাঁচ বছরে শুধু মাদারীপুরেই মানবপাচারের মামলা হয় ২৪৭টি। যার আসামী ১ হাজার ২৫২ জন। যদিও আটক মাত্র ১৬৪ জন। তবে সাজা হয়নি একজনেরও।
ছেলে তার স্বপ্ন দেখেছিলো অনেক, তবে ভূমধ্যসাগর দুঃস্বপ্ন হয়ে মায়ের চোখে দুঃখ সেঁটে দিলো। হাজারবার মানা করেছিলেন মা, কিছু সন্তানও নাছোড়বান্দা। অবশেষে একমাত্র আবাদি জমি বেঁচে জোগাড় করেছিলেন ইউরোপ যাবার টাকা। যদিও অবৈধ আর বিপদসংকুল পথটুকু পাড়ি দেয়া হয়নি, অথৈই সাগরেই মৃত্যু হয় মামুন শেখের।
মামুন শেখের মা বলেন, ছেলে আমার পাগল হয়ে গেছিল। তার বন্ধু বান্ধব সবাই বাহিরে চলে গেছে। তারা বলতো মামুন চলে আয়। কিন্তু ওরা যদি বলতো এত কষ্ট তাহলে আমার বাবা (ছেলে) বুঝতো এভাবে বিদেশ যাওয়া যাবে না।
ভূমধ্যসাগরের সেই একই জল কান্না হয়েছে মাত্র পাঁচ কিলো দূরে থাকা স্কুল পড়ুয়া সজীব কাজীর মায়ের চোখেও। সেই একই নৌকাতেই একমাত্র সন্তানের মৃত্যু। মায়ের জীবনটাকেই আজীবনের জন্য করে দিয়েছে এলোমেলো।
সজীব কাজীর মা বলেন, ছেলে বলতো সারাদিন বসে থাকলে কি ভালো লাগে। তখন আমি বলতাম তুই পড়া লেখা কর। সে বলতো পড়ে কি করবো। ভাইরা পড়ালেখা করছে কিন্তু চাকরি পায় না। শুধু পড়া লেখা করে টাকা খরচ করবো কেন।
শ্রাদ্ধ চলছে মাত্রই কলেজে ওঠা নয়ন বিশ্বাসের, অদম্য স্বপ্নটাই যে জীবনটাকে ডুবিয়েছে ভূমধ্যসাগরে। মাদারিপুরের রাজৈর উপজেলায় কান পাতলেই শোনা যায় এমন আর্তনাদ। কেননা চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে মৃত ৮ বাংলাদেশির পাঁচজনই এই উপজেলার।
স্থানীয়রা জানান, ঝুঁকি নিয়ে এমন পথে বিদেম না যাওয়াই ভালো। যারা মারা গেছে তারা তো ফিরবেন না। কিন্তু এমন পথে যেনো আর কেউ বিদেশ না যায়।
এরপরও বিশ্বের অন্যতম প্রাণঘাতী এই পথে কেন যাচ্ছে বাংলাদেশিরা? উত্তর খুঁজতে একই নৌকা থেকে বেঁচে ফেরা বাঁধন মন্ডলের সাথে কথা হয়। তিনি বলেন, বিদেশ যাওয়ার জন্য প্রস্তুত নেয়ার পর আমাকে বলা হয়েছিলো যে ১ বছরের মধ্যে ভিসা হয়ে যাবে। এর জন্য ১ লাখ টাকা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু আমাকে পরে জানানো হয় যে ভিসা হবে না। ৩০ হাজার টাকা নিয়ে যাও আর বাকি টাকা ফেরত দেয়া হবে না। পরে আমরা এই পথে লিবিয়ার পথ বেছে নিতে হয়েছে।
বাংলাদেশের অবৈধ অভিবাসন এলাকাগুলোর মধ্যে অন্যতম মাদারীপুর। হিসেব বলছে, গত এক দশকে ভূমধ্য সাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে মৃত্যু হয়েছে অসংখ্য বাংলাদেশির, যাদের অনেকের বাড়ি এই রাজইর উপজেলায়।
প্রলোভনের ফাঁদে এমন মৃত্যু এবারই প্রথম নয়, তবে এটিই শেষ তাও কী বলা যাবে? কারণ গত পাঁচ বছরে মাদারীপুরে মানবপাচারের ২৪৭টি মামলায় ১ হাজার ২৫২ জন আসামি হলেও আটক মাত্র ১৬৪ জন। সাজা হয়নি একটিতেও।
মাদারীপুরের পুলিশ সুপার মাসুদ আলম বলেন, মানব পাচারের সাথে যদি কেউ জড়িত হয় অথবা অন্য কোনো অপরাধের সাথে যদি জড়িত হয় তাহলে আমরা তাদের ছাড় দেই না। তবে একটি ঘটনায় অনেকেই ১০-১৫ জনের নামে মামলা দেয়। কিন্তু এসব মামলায় সবাই কিন্তু সম্পৃক্ত থাকে না।
জাতিসংঘের পরিসংখ্যানে, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ পৌঁছানোর তালিকার শীর্ষে বাংলাদেশ ২১ শতাংশ। আর যারা মারা যাচ্ছেন তাদের ১২ ভাগই বাংলাদেশি।