ব্রিটেনে বাঙালিপাড়ায় ভোট: শেষ মুহূর্তের হিসাব-নিকাশ
পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস একটি দ্রুত বিকাশমান পৌর এলাকা। অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই কাউন্সিলের ভেতরে আছে বাঙালি অধ্যুষিত দুটি আসন— ‘বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড বো’ এবং ‘পপলার অ্যান্ড লাইমহাউজ’। এই দুই আসনে এখন প্রতিনিধিত্ব করছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত দুই নারী রুশনারা আলী ও আফসানা বেগম। আগামী বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে ভোটের লড়াইয়ে রুশনারা ও আফসানার পাশাপাশি লড়ছেন আরও কয়েকজন প্রার্থী। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই দুই আসনের ভোটে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করছে টাওয়ার হ্যামলেটসের বাঙালি মেয়র লুৎফুর রহমানের সমর্থন। কিন্তু এক্ষেত্রে তিনি নীরব ভুমিকা পালন করছেন। সবমিলিয়ে নানান হিসাব-নিকাশে জমে উঠেছে শেষ মুহূর্তের নির্বাচনি মাঠ।
দলীয়ভাবে এখনও পর্যন্ত ব্রিটেনের সব নির্বাচনি জরিপে বর্তমান বিরোধীদল লেবার পার্টি আসন্ন নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার দৌড়ে এগিয়ে রয়েছে। কিছুদিন আগেও এই দুই আসনে দুই লেবার প্রার্থী রুশনারা আলী ও আফসানা বেগম জয়ের ব্যাপারে অনেকটাই নির্ভার ছিলেন। তবে সম্প্রতি এক টেলিভিশন শো-তে নির্বাচনি বিতর্ক চলাকালে ‘অযাচিতভাবে’ বাংলাদেশের নাম টেনে আনেন যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে লেবার পার্টির নেতা স্যার কিয়ার স্টারমার। তিনি বলেন, ‘ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো থেকে আসা যাদের বৈধ কাগজপত্র নেই, তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে।’
এ নিয়ে ব্যাপক জলঘোলা হয়েছে, প্রত্যাশিতভাবেই তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় টাওয়ার হ্যামলেটসে। বাংলাদেশিরা রীতিমতো সভা-সমাবেশ করে সেই ‘অযাচিত বক্তব্যের’ প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এমনকি প্রতিবাদ সমাবেশেও দুই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে পরস্পর বিরোধিতার উত্তেজনা দেখা গেছে। অবশ্য স্টারমার তার সেই বক্তব্যের পর চাপের মুখে দফায় দফায় ‘দুঃখ প্রকাশ’ করেন, শেষ পর্যন্ত তার দল থেকে ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়। তাতে বাংলাদেশিদের ক্ষোভ কিছুটা প্রশমিত হয়েছে।
এছাড়া ফিলিস্তিন ইস্যু নিয়েও টাওয়ার হ্যামলেটসে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে লেবার-বিরোধী মনোভাব অতীতের যেকোনও সময়ের চেয়ে এখন প্রবল। ভোটের হিসাবে এটিকেও একটি পয়েন্ট হিসেবেই গুণছেন অনেকে। জানা গেছে, ফিলিস্তিন ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে ‘বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড বো’ আসনের লেবার দলীয় প্রার্থী, টানা ১৪ বছর ধরে এমপি থাকা রুশনারা আলীকে লেবারের নিরাপদ এই আসনে এবার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন নিজেদের ফিলিস্তিনপন্থী দাবি করা লিবারেল ডেমোক্র্যাট প্রার্থী রাবিনা খান এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী আজমল মাশরুর। তা ছাড়া নির্বাচন হয়ে গেলে ভোটারদের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকা, নির্বাচনি মৌসুম ছাড়া কমিউনিটির অনুষ্ঠানগুলোতে অংশ না নেওয়াসহ কিছু অভিযোগও রয়েছে রুশনারা আলীর বিরুদ্ধে।
তার বিরুদ্ধে প্রার্থী হওয়া দুই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত দুজনের মধ্যে রাবিনা খান ২০১৫ সালে লুৎফুর রহমানের সমর্থন নিয়ে টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়র পদে নির্বাচন করে অল্প ভোটে হেরে যান (ওই বছর নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালের নিষেধাজ্ঞায় প্রার্থী হতে পারেননি লুৎফুর রহমান)। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী আজমল মাশরুর তো পোস্টারে লুৎফুর রহমানের ছবিই ব্যবহার করছেন। তাই এই আসনে এখন ব্যক্তি হিসেবে এককভাবে সবচেয়ে ‘বড় ফ্যাক্টর’ হয়ে দাঁড়িয়েছেন তিনবার নির্বাচিত মেয়র লুৎফুর রহমান।
লুৎফুর রহমান বেড়ে উঠেছেন টাওয়ার হ্যামলেটসেই। স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় এই রাজনীতিক নিজের পরিচয় দেন ‘এই এলাকারই একজন ছেলে’ হিসেবে। অবশ্য তার রাজনীতির শুরুটা লেবার পার্টির হাত ধরেই। তিনি একসময় স্থানীয় লেবার পার্টিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন। তাকে দলের মধ্যে একজন সম্ভাবনাময় উদীয়মান তারকা হিসেবে দেখা হচ্ছিল। টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য ২০১০ সালে তিনি লেবার পার্টির মনোনয়ন পান, কিন্তু পরে পার্টি তার মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেয়। তখন তিনি বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেব স্বতন্ত্র প্ল্যাটফর্ম থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হন। ২০১৪ সালে তিনি আবারও পুন-নির্বাচিত হন মেয়র পদে। কিছুদিনের মাথায় নির্বাচনে প্রতারণা এবং কাউন্সিলের ব্যবস্থাপনায় নানা অনিয়মের অভিযোগে ২০১৫ সালে তাকে মেয়র পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। নির্বাচনি ট্রাইব্যুনাল তাকে ৫ বছরের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। সবাইকে অবাক করে ২০২২ সালে কাউন্সিল নির্বাচনে বিপুল ব্যবধানে জয় নিয়ে আবারও মেয়র নির্বাচিত হন লুৎফুর রহমান। এরই মধ্যে ‘অ্যাসপায়ার পার্টি’ নামে একটি দলও গঠন করেছেন।
আজমল ও রাবিনা দুজনের সঙ্গেই প্রকাশ্যে কাজ করছেন লুৎফুরের কিছু সমর্থক। এই দুই প্রার্থীর সমর্থকরাই সাধারণ ভোটারদের কাছে বলছেন, মেয়রের নীরব সমর্থন তাদের দিকে রয়েছে। তাই শেষ পর্যন্ত মেয়র নিজের সমর্থন প্রকাশ করবেন, নাকি কৌশলগত কারণে নিশ্চুপ থাকবেন, তার ওপরও কিছুটা নির্ভর করবে ভোটের ফল।
অবশ্য আজমল মাশরুর ‘বিনা অনুমতিতে’ তার নির্বাচনি লিফলেটে মেয়র লুৎফুর রহমানের ছবি ব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগ করেছে মেয়রের দল এসপায়ার পার্টি। পার্টির চেয়ারম্যান আবু তাহের চৌধুরী আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে এমন অভিযোগ তুলে নির্বাচনি লিফলেট থেকে বিনা অনুমতিতে প্রকাশিত মেয়রের ছবি প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আজমল মশরুর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি আমার লিফলেটের কোথাও বলিনি, মেয়র বা তার দল আমাকে সমর্থন দিয়েছে।’
এ আসনে লিবডেমের প্রার্থী রাবিনা খান ২০১৫ সালে লুৎফুর রহমানের সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়র পদে নির্বাচন করে অল্প ভোটে হেরে যান। রাবিনা খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বৃহস্পতিবারের ভোটে মেয়র লুৎফুর রহমান যে আজমল মশরুরকে সমর্থন দেননি, সেটা তার দলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কৌশলী লুৎফুর ও তার দল এই দুজনের (রাবিনা ও আজমল) কাউকেই সমর্থন না দেওয়ায় অন্যরকম বাড়তি সুবিধা পাচ্ছেন রুশনারা আলী। তা ছাড়া জনশ্রুতি আছে, লেবার পার্টি যদি ক্ষমতায় আসে, আর বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড বো আসনে যদি রুশনারা আলী জয় পান— তাহলে এবার হয়তো তিনি জায়গা করে নিতে পারেন ব্রিটেনের মন্ত্রিসভায়। সিলেটের বিশ্বনাথের ভুরকি গ্রামে জন্ম নেওয়া ৪৯ বছর বয়সী রুশনারা মা-বাবার সঙ্গে শৈশবেই লন্ডনে এসেছিলেন। আসনটিতে টানা চারবার নিজের কর্তৃত্ব ধরে রাখা এই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এমপির মন্ত্রী হওয়ার গুঞ্জন এরইমধ্যে বাংলাদেশি ভোটারদের মধ্যে ইতিবাচক মাত্রা যোগ করেছে। সবমিলিয়ে রুশনারা আলী জয়ের ব্যাপারে অনেকটাই এগিয়ে।
টাওয়ার হ্যামলেটসের ভেতরের অপর সংসদীয় আসন পপলার লাইম হাউজ আসনে লেবার পার্টির প্রার্থী আফসানা বেগম। এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আপসানার সাবেক স্বামী এহতেশামুল হকসহ মোট আট জন প্রার্থী। এ আসনেও লুৎফুর রহমানের বিপুল সংখ্যক সমর্থক ফিলিস্তিনসহ নানা ইস্যুতে সোচ্চার লেবার প্রার্থী আফসানা বেগমের পক্ষে প্রকাশ্যে সক্রিয় রয়েছেন। আসনটিতে অনেককটা নিশ্চিত বিজয়ের অপেক্ষায় আছেন তিনি।
নিজ নির্বাচনি এলাকার দুটি আসনে প্রকাশ্যে বা নীরবে কাউকে সমর্থন দিচ্ছেন কিনা বা নিজের ভোট কাকে দেবেন, বাংলা ট্রিবিউনের এ প্রশ্নের জবাবে কথা বলতে রাজি হননি টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়র লুৎফুর রহমান।
উল্লেখ্য, যুক্তরাজ্যের আসন্ন নির্বাচনে ছোট-বড় প্রায় ৯৮টি রাজনৈতিক দল অংশ নিচ্ছে। হাউস অব কমন্সের ৬৫০ আসনের বিপরীতে দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মিলে এবার রেকর্ডসংখ্যক ৪ হাজার ৫১৫ জন প্রার্থী ভোটযুদ্ধে শামিল হয়েছেন। ব্রিটেনের এবারের সংসদ নির্বাচনে বিভিন্ন দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ৩৪ জন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এদের মধ্যে জয়ের সম্ভাবনায় এগিয়ে আছেন লেবার পার্টি থেকে মনোনীত ছয় নারী প্রার্থী। সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন