সিলেটে শিশু মুনতাহা হত্যা: গৃহশিক্ষিকাসহ ৪ আসামি ৫ দিনের রিমান্ডে
সিলেটের কানাইঘাটে আলোচিত শিশু মুনতাহা আক্তার জেরিন (৬) হত্যা মামলায় সাবেক গৃহ শিক্ষিকাসহ চার জনকে হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়েছে পুলিশ। রহস্য উদঘাটনের পাশাপাশি এ হত্যার সঙ্গে আরও কারও সংশ্লিষ্টতা আছে কি না সেটি খতিয়ে দেখতে আদালতে আসামিদের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা।
সোমবার (১১ নভেম্বর) বেলা ২টার দিকে তাদের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তোলা হয়। পরে ৭ দিনের রিমান্ড চাওয়া হলে বিচারক কাজী মো. আবু জাহের বাদল ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এর আগে মুনতাহার বাবা শামীম আহমদ শনিবার (৯ নভেম্বর) কানাইঘাট থানায় অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি অপহরণ মামলা করেন। এরপর থেকেই পুলিশ সন্দেহভাজনদের ওপর নজরদারি বাড়ায়।
আটক ব্যক্তিদের ওই মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। নিহত মুনতাহা কানাইঘাট সদরের বীরদল ভাড়ারিফৌদ গ্রামের শামীম আহমদের মেয়ে।
গ্রেফতারকৃতরা হলেন, কানাইঘাট থানার বীরদল ভাড়ারীফৌদ গ্রামের মৃত ময়না মিয়া আলিফজান (৫৫) ও তার মেয়ে শামীমা বেগম মার্জিয়া (২৫), একই এলাকায় ইসলাম উদ্দিন (৪০) ও নাজমা বেগম (৩৫)।
কানাইঘাট থানার ওসি আব্দুল আউয়াল বলেন, মামলার তদন্তের স্বার্থে আসামিদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে হত্যাকাণ্ডের পেছনে আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সিলেটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) রফিকুল ইসলাম বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা হত্যার কথা স্বীকার করেছে। তাদের মাধ্যমে ঘটনার পুরো প্রক্রিয়া সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা চলছে। আরও কয়েকজনের নাম এসেছে, যাদের ধরতে অভিযান অব্যাহত আছে।
গত ৩ নভেম্বর রোববার বাড়ির পাশে খেলতে গিয়ে নিখোঁজ হয় মুনতাহা। এক সপ্তাহ পর রোববার (১০ অক্টোবর) রাত পোহানোর আগেই মিললো ভয়ঙ্কর খবর। মুনতাহাকে হত্যার পর মরদেহ বাড়ির পাশের একটি খালে কাঁদামাটিতে চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল সপ্তাহদিন।
হত্যাকাণ্ডটি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে চাপা দেওয়া অবস্থা থেকে উদ্ধার করেন মর্জিয়ার মা আলিফজান। মুনতাহার মরদেহ কোলে তুলে পুকুরে ফেলার চেষ্টাকালে স্থানীয়রা তাকে হাতেনাতে আটক করে।
এই ঘটনায় অভিযুক্ত মর্জিয়া আক্তার, তার মা আলীফজান ও আলীফজানের মা কুতুবজানকে আটক করা হয়। ঘটনার পর বিক্ষোব্ধ জনতা মর্জিয়ার বসতঘর গুড়িয়ে দেন। শিশু সন্তানের গলিত নিথর দেহ দেখে বার বার মুর্ছা যাচ্ছেন মুনতাহার বাবা-মা, স্বজনরা।
নিহত মুনতাহা (৬) সিলেটের কানাইঘাট উপজেলা সদর ইউনিয়নের বীরদল ভাড়ারীফৌদ গ্রামের শামীম আহমদের মেয়ে।
মুনতাহার মরদেহ দেখে কাঁদছেন বীরদল গ্রামবাসি, কাঁদছেন দেশ-বিদেশের মানুষ। গ্রামের জড়ো হওয়া লোকজনও বিলাপ করছেন শিশুটির জন্য। আর্তনাদে যেনো বীরদল গ্রামের বাতাস ভারি হয়ে ওঠেছে।
হত্যাকান্ডের নেপথ্যের কারণ-
স্থানীয়রা জানান, মুনতাহাকে ২৫০ টাকায় প্রাইভেট পড়াতো মর্জিয়া। তার মা আলিফজান ভিক্ষাবৃত্তি করতেন। ঘরে তার আশিউর্ধ্ব নানি রয়েছেন। মর্জিয়া চুরির ঘটনায় এবং তার চলাফেরা খারাপ প্রতিয়মান হওয়াতে টিউশনি থেকে তাকে বাদ দেন সেলিম আহমদ। সেই ক্ষোভে প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে ওঠে মর্জিয়া। সেলিম আহমদের উপর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে শিশু মর্জিয়াকে অপহরণের পর হত্যা করে।
জনতার হাতে আটকের পর মর্জিয়ার মা আলিফজান বেগম বলেন, ‘অপহরণের পর মর্জিয়াকে আটকাতে চেয়েছিলেন। তখন মেয়ে তাকে বলে টাকা ৫ লাখ পাইমু, আমি আরো দুইটা শিশু আনিয়া দিতাম। অপহরণের রাতে শিশুটিকে জীবিত ঘরে নিয়ে আসে। এরপর আবার তাকে নিয়ে যায়। পরে কী করছে জানিনা। এই ঘটনায় যাতে নিজে ফেঁসে যেতে পারেন ভেবে ঘরের পাশের খালে কাঁদামাটি থেকে শিশুটির মরদেহ কোলে করে নিয়ে পুকুরে ফেলার চেষ্টাকালে তিনি ধরা পড়ে যান।
স্থানীয়দের অভিযোগ, মার্জিয়া খাপার প্রকৃতির মহিলা। তার অনেক মোবাইল ও বেশি কিছু সীম রয়েছে। তাদের ধারণা অপহরণকারী সিন্ডিকেটের হয়ে কাজ করে সে। যদিও প্রতিহিংসা পরায়ন হয়ে হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। কিন্তু তার সঙ্গে আরো লোকজন জড়িত থাকতে পারেন। তাদের খোঁজে বের করে গ্রেফতার ও কঠিন শাস্তির দাবি জানান তারা।
স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল ওয়াহিদ বলেন, গত রোববার (৩ নভেম্বর) আমার বাড়িতে খেলা করছিল শিশুটি। সেখান থেকে অপহরণ করে মরদেহ ঘরের পাশে খালে পুঁতে রাখার হবে কল্পনা করতে পারিনি। আমাদের বিশ্বাস ছিল শিশুটিকে জীবিত পাবো। এই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেন তিনি।
মারজিয়ার স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে সিলেটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম এন্ড অপস্) মো. রফিকুল ইসলাম জানান, গত ৩ নভেম্বর রাতেই মুনতাহাকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যার পর মরদেহ খালে পুঁতে রাখা হয়। মারজিয়াকে শিক্ষকতা থেকে অব্যাহতি দেওয়ায় ও তার ওপর চুরির অপবাদে ক্ষোভ থেকে এই হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারেন ধারণা করা হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, মুনতাহা হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে আরও তিনজনকে আটক করা হয়েছে। তারা হলেন- নিজাম উদ্দিন, ইসলাম উদ্দিন ও নাজমা বেগম। হত্যাকাণ্ডে আরও কেউ জড়িত রয়েছে কি না তা উদঘাটন করতে আটকদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
কানাইঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল আউয়াল এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, প্রতিবেশি মর্জিয়া আক্তার ও তার মা আলীফজান মিলে মুনতাহাকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যার পর মরদেহ গুম করতে কাঁদামাটিতে চাপা দিয়ে রাখে। অপহরণের পর রাতেই শিশুটিকে হত্যা করা হয়। রোববার ভোরে আলীফজান বেগম মরদেহ সরানোর চেষ্টাকালে স্থানীয়রা দেখে ফেলেন। পরে পুলিশ গিয়ে মরদেহ উদ্ধার করে। এসময় মর্জিয়া মা ও নানিকেও আটক করা হয়েছে।
তিনি বলেন, শনিবার (১০ নভেম্বর) দিনগত রাত ১২টার দিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মর্জিয়াকে আটক করে থানায় নেওয়া হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদকালে কোনো তথ্য উদঘাটন করা যায়নি। বরং সহজভাবে হেসে হেসে সব প্রশ্নের উত্তর উড়িয়ে দিচ্ছিল। এরপর ভোররাতে মরদেহ উদ্ধারের পর তাকে আটক দেখানো হয়।
তিনি আরও বলেন, মুনতাহার মরদেহ খাল থেকে সরিয়ে নিয়ে পাশ্ববর্তী পুকুরে ফেলার চেষ্টা করে। মূলত; হত্যাকারীর উদ্দেশ্য ছিল মুনতাহার মরদেহ পুকুরে ফেলে মূল ঘটনা ব্যাহত করার চেষ্টা করা হয়।
এরআগে মুনতাহাকে পরিকল্পিতভাবে অপহরণ করা হয়েছে দাবি করে শামীম আহমদ বলেন, কারো সঙ্গে বিরোধ নেই, প্রিয় দেশবাসী। সবার পায়ে পড়ি আমার মেয়েটিকে ফিরিয়ে দিন। কারো ক্ষোভ থাকলে আমাকে মেরে ফেলুন, আমার মেয়েকে ছেড়ে দিন।
৬নং বীরদল ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য সেলিম আহমদ বলেন, সেলিম আহমদের প্রথম স্ত্রী মারা যান ৩ ছেলে ও এক মেয়ে রেখে। ২য় স্ত্রীর ঔরসজাত ২ ছেলে ও এক মেয়ে। তন্মধ্যে মুনতাহা বড়। সে বীরদল মাদানিয়া মাদরাসার প্রথম শ্রেনীর ছাত্রী। আমরা সার্বিকভাবে চেষ্টা করছি শিশুটিকে অক্ষত অবস্থায় পেতে। কিন্তু এমন দৃশ্য দেখতে হবে স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।
কানাইঘাট সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আফসর আহমদ বলেন, মুনতাহার সন্ধানে কেবল তার পরিবার না। পুরো গ্রামের মানুষ দোয়া করছেন, যাতে মুনতাহাকে ফেরত পাওয়া যায়। শিশুটিকে ফিরে পেতে গত শুক্রবার ঘটনাটি র্যা ব-৯ ‘র সহযোগীতা চাওয়া হয়েছে। দেশ-বিদেশ থেকে লোকজন শিশু মুনতাহার সন্ধান চেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নগদ অর্থসহ পুরস্কার ঘোষণা করেছে। প্রতারক চক্রের সদস্যরাও টাকা হাতিয়ে নিতে ধান্দা করেছে। একটি নাম্বার থেকে এক লাখ টাকা মুক্তিপন দাবি করা হয়েছে। যে যেখানে বলছে, সেখানেই খোঁজ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এমন পরিণতির জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না।
গত ৩ নভেম্বর সকালে বাড়ির অদূরে একটি মাদ্রাসার জলসা (ওয়াজ মাহফিল) থেকে ছেলে আব্দুর রহিম ও মেয়ে মুনতাহাকে নিয়ে বাড়ি ফেরেন শামীম আহমদ। সেখান থেকে তাদের ফলফ্রুট কিনে দেন। এরপর মুনতাহা শিশুদের সঙ্গে বাড়ির সামনের সড়কে খেলতে যায়। বেলা আড়াইটার দিকে খাবার খেতে মুনতাহার ডাক পড়ে। খুঁজতে গিয়েও শিশুটিকে আর পাওয়া যায়নি। এরপর ওইদিন রাত ১২টায় মুনতাহার বাবা শামীম আহমদ কানাইঘাট থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।