মৃত্যুদণ্ড চূড়ান্তের আগে ফাঁসির আসামিকে কনডেম সেলে নেওয়া অবৈধ : হাইকোর্ট
মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে কারাগারের কনডেম সেলে বন্দি রাখা অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। এ ছাড়া আগামী দুই বছরের মধ্যে জেল কর্তৃপক্ষকে ডেথ সেলে যারা বন্দি আছেন, তাদেরকে ক্রমান্বয়ে অন্য ব্যবস্থাপনা করে মৃত্যু সেল থেকে সরিয়ে সাধারণ বন্দিদের সঙ্গে বসবাসের সুযোগ করে দিতে বলা হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে শুধু বিশেষ বিবেচনায় কোন বন্দিকে আলাদা করে নির্জন কক্ষে রাখা যাবে।
এক রিটের চূড়ান্ত শুনানি করে সোমবার (১৩ মে) বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি মো. বজলুর রহমানের বেঞ্চ এ রায় দেন।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত তালুকদার। সঙ্গে ছিলেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল নাসিম ইসলাম রাজু।
রায়েরে পর অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, এটা একটা ঐতিহাসিক রায়। রায়ের বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড চূড়ান্ত হওয়ার পূর্বে তাকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রাপ্ত আসামি বলা যাবে না এবং তাকে কারাগারের নির্জন ডেথ সেলে বন্দি রাখা যাবে না। মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত বলতে, এখানে যত বিচারিক ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়া আছে সেগুলো শেষ হওয়াকে বোঝানো হয়েছে। বিচার বিভাগীয় পদক্ষেপে যেমন- হাইকোর্ট বিভাগ, আপিল বিভাগ এবং রিভিউয়ের শুনানি শেষেও যদি কারও মৃত্যুতদণ্ড বহাল থাকে তাহলে প্রশাসনিক পদক্ষেপ হিসেবে সে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগ পান। রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রার্থনার আবেদন খারিজের পরই একজন মানুষের মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হয়েছে বলা যাবে এবং শুধু তখনই একজন বন্দিকে নির্জন কক্ষে (ডেথ সেলে) বন্দি রাখা যাবে। তার আগে ডেথ সেলে বন্দি রাখা যাবে না।
তিনি আরও বলেন, বিশেষ বিবেচনায় যদি কোনো বন্দির বিশেষ কোনো অসিুবিধা থাকে, এটা হতে পারে ফিজ্যিক্যাল অসুবিধা, সংক্রামক কোনো রোগ থাকলে অথবা অন্য কোনো সেক্সচ্যুয়াল রোগ থেকে থাকে, তাহলে তাকে আলাদা করে রাখা যাবে। এক্ষেত্রে এ ব্যক্তিকে নির্জন কক্ষে রাখার ব্যাপারে আলাদা করে শুনানি নিতে হবে। শুনানি নেওয়ার পর তাকে নির্জন সেলে রাখা যাবে।
শিশির মনির বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ এ মামলার শুনানিতে আদালতে বলেছেন, নতুন জেল কোড তৈরি করতে যাচ্ছে, নতুন প্রিজন অ্যাক্ট হচ্ছে। হাইকোর্ট রায়ে বলেছেন, এই রায়ে যেসব পর্যবেক্ষণ দেওয়া হচ্ছে সেগুলো যেন নতুন আইনে প্রতিফলিত হয়।
রায়ের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে শিশির মনির আরও বলেন, আমাদের দেশে হাইকোর্ট বিভাগে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের জামিনের দরখাস্তের শুনানি হয় না। অন্যান্য আসামিদের জামিন শুনানি হয়। তারা জামিন পেয়ে বেরিয়ে যান। কিন্তু মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত একবার হলেই তাদের জামিনের আর শুনানি হয় না। এ ক্ষেত্রে হাইকোর্ট রায়ে বলেছেন, মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত যাদের আপিল বিচারাধীন থাকে, তাদের জামিন আবেদনও যেন অন্যান্য আসামিদের মতো শুনানি করা হয় এবং জামিনও যেন মঞ্জুর করা হয়।
হাইকোর্ট জেল কর্তৃপক্ষকে বলেছেন, মৃত্যু সেলে যারা বন্দি থাকেন, তাদের ব্যাপারে কোনো সাংবাদিক বা কোনো গবেষক বা অন্য কেউ তথ্য অধিকার আইনে দরখাস্ত দিয়ে জানতে চাইলে, তাদেরকে যেন বিস্তারিত তথ্য দেওয়া হয়। এ ছাড়াও সুপ্রিমকোর্ট এবং হাইকোর্ট প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন, কতজনের মৃত্যুদণ্ড কমছে, কতজনের বহাল থাকছে- এসব ব্যাপারে কোনো ব্যক্তি তথ্য অধিকার আইনে বা সাংবাদিকরা তথ্য চাইলে তা যেন দেওয়া হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের এসব তথ্য পরিসংখ্যানসহ সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে এবং বার্ষিক প্রতিবেদনে প্রকাশও করতে বলা হয়েছে।
মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে দণ্ডিত বা দণ্ডিতদের কনডেম সেলে রাখার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালের ২ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টে রিট করেন চট্টগ্রাম, সিলেট ও কুমিল্লা কারাগারের কনডেম সেলের তিন কয়েদি। তারা হলেন- সাতকানিয়ার জিল্লুর রহমান, সুনামগঞ্জের আব্দুল বশির ও খাগড়াছড়ির শাহ আলম। ওই রিট শুনানি করে ২০২২ সালের ৫ এপ্রিল রুল জারি করেন হাইকোর্ট।
মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে দণ্ডিতদের কনডেম সেলে রাখা কেন আইনত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না এবং মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রাপ্তদের কনডেম সেলে বন্দি রাখা সংক্রান্ত কারাবিধির ৯৮০বিধিটি কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয় রুলে। সেইসঙ্গে কনডেম সেলে রাখা বন্দিদের কী ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়, সে বিষয়ে প্রতিবেদন চান আদালত।
রিটে বলা হয়, বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডাদেশ ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক সাজা কার্যকর করার আইনগত কোনো বিধান নেই। ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৭৪ ধারা অনুসারে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হাইকোর্ট বিভাগের অনুমোদন (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) নিতে হয়। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪১০ ধারা অনুসারে বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি হাইকোর্টে আপিল করতে পারেন। হাইকোর্টে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকলে এর বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করার সুযোগ আছে দণ্ডিত ব্যক্তির। সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন করার সুযোগ আছে।
এ ছাড়া সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারেন। ক্ষমার এ আবেদন রাষ্ট্রপতি যদি নামঞ্জুর করেন, তাহলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে সরকার আইনগত বৈধতা পায়। অথচ বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডাদেশের পরপরই সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে কনডেম সেলে বন্দি রাখা হচ্ছে। হাইকোর্টে মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের আগে দণ্ডিত ব্যক্তিকে কনডেম সেলে রাখা তার মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি।
গত বছরের ১২ ডিসেম্বর এ রুলের ওপর শুনানি শেষ হয়। রুল শুনানিতে আদালত এ বিষয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী প্রবীর নিয়োগী ও এস এম শাহজাহানের বিশেষজ্ঞ মত নেন। রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন শুনানি করেন। আবেদনকারীদের পক্ষে শুনানি করেন মোহাম্মদ শিশির মনির। রুলের ওপর শুনানি শেষে রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমান রাখা হয়। সে অনুযায়ী হাইকোর্ট আজ রায় ঘোষণা করেন।