অভিযান শেষ, রাজনীতির জোরে টিকে গেল মুরগির ফার্ম

জমিতে অবৈধভাবে নির্মিত স্থাপনা সরাতে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। যেখানে ক্ষমতার জোর নেই সেখানে দেদারসে চলছে অভিযান। আর যেখানে ক্ষমতার জোর আছে, সেখানে যেন পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে রেলওয়ে। টিকে থাকছে ক্ষমতাসীনদের মুরগির ফার্ম। আর ভেঙে ফেলা হচ্ছে উদ্বাস্তু মানুষের ১০ ফিটের একমাত্র থাকার ঘর।
মঙ্গলবার (২১ জানুয়ারি) দুপুর ১২টার দিকে তেজগাঁও রেলওয়ে স্টেশনের আগে তেজগাঁও-ফার্মগেট রেলগেট এলাকায় রেলওয়ের জমিতে অবৈধভাবে নির্মিত স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযানে যায় বাংলাদেশ রেলওয়ে। এই অভিযানের নেতৃত্ব দেন রেলওয়ে ঢাকা বিভাগীয় ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. নাসির উদ্দিন মাহমুদ।
রাজধানীর তেজগাঁও-ফার্মগেট রেলগেট এলাকায় থেকে এফডিসি রেলগেট এলাকা পর্যন্ত রেললাইনের দুইপাশে বহু মানুষের ঘর। এসব ঘর তৈরি করা হয়েছে টিন, বাঁশ আর কাঠ দিয়ে। যা যেকোনো সময় সরিয়ে ফেলতে পারবেন ঘরের বাসিন্দারা। এসব মানুষ কাজ কারেন পাইকারি আড়ত কারওয়ান বাজারে। পাশাপাশি একই জায়গায় ক্ষমতাসীনরা মেঝে পাকা করে স্টিল ফ্রেমে উঁচু করে তৈরি করেছেন মুরগির ফার্ম।
ঘটনাস্থলে সরেজমিনে দেখা যায়, একটি এক্সক্যাভেটর নিয়ে অভিযানে আসেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। এ সময় তার সঙ্গে উপস্থিত ছিল রেলওয়ের অন্যান্য কর্মচারী, রেলওয়ে পুলিশ ও তেজগাঁও থানা পুলিশ। শুরুতে তিনি একটি বড় মুরগি ফার্মের কাছে যান এক্সাভেটর নিয়ে। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের জোরে সেই ফার্মে এক্সক্যাভেটর চালানোর অনুমতি দিতে পারেননি তিনি। বাধ্য হয়ে ফিরে আসতে হয় তাকে। পরে তিনি লাইনের পাশে থাকা প্রতিবাদ করতে না পারা অসহায় মানুষদের ১০/১২ ফিটের ছোটখাটো ঝুপড়ি ঘরগুলো গুড়িয়ে দেওয়ার অনুমতি দেন। একের পর এক ঝুপড়ি ঘর মাটিতে মিশে যেতে থাকে । এদিকে রেললাইনের পশ্চিম পাশে থাকা জায়গায় পার্ক করে রাখা কিছু ভ্যানগাড়িও ভেঙে ফেলা হয়। সবমিলিয়ে ৩০ মিনিটের মতো চলে অভিযান।dhakapost
সেখানে উপস্থিত স্থানীয়রা জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতা মিলেমিশে নির্মাণ করেছেন এ মুরগি ফার্ম। তাদের অভিযোগ, আমাদের টাকা দেওয়ার ক্ষমতা নাই, তাই আমাদের ঘরগুলো ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তারা টাকা দেওয়ার কারণেই তাদের ঘরগুলো ভাঙতে পারছে না। শুধু কমলাপুর থেকে তেজগাঁও নয়, এভাবে টঙ্গী পর্যন্ত অন্তত কয়েকশ একর জমি দখল হয়েছে নানান সময়। এদিকে রেলওয়ে বলছে, পর্যায়ক্রমে তা উদ্ধারে অভিযানে চালানো হবে।
তেজগাঁও থেকে ঢাকা স্টেশনে যেতে এটিই সবচেয়ে বড় কার্ভ (বাঁকা) রেললাইন। এই কার্ভ দিয়ে কোনো ট্রেন যেতে-আসতে লোকো মাস্টারদের (চালক) প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে মুরগি ফার্ম নামের উঁচু উঁচু শক্ত স্থাপনাগুলো। তারা সামনের অংশে ভালোভাবে দেখতে পান না। ফলে প্রায়ই দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায় এখানে।
ঢাকা রুটে নিয়মিত ট্রেন চালান এমন কয়েকজন লোকো মাস্টার ঢাকা পোস্টকে জানান, তেজগাঁওয়ের ওই কার্ভ লাইনে কোনো কিছু না থাকাই ভালো। কারণ, এই কার্ভ লাইনটা এতোটাই কার্ভ যে, খুব বেশিদূর দেখা যায় না। কার্ভের কাছে ওই ফার্মগুলোতে এখন কালো কাপড় দেওয়া। কিন্তু মাঝে মাঝে লাল কাপড়ও থাকে। তখন আমরা কনফিউজড হয়ে যাই। আমরা কার্ভ লাইনে দূর থেকে বুঝতে পারি না, লাল কাপড় রেললাইনের ভেতরে নাকি বাইরে। ফলে প্রতিবন্ধকতা ভেবে ট্রেনের গতি কমাতে হয়।
অভিযানে ঝুপড়ি ঘর ভেঙেছে রোকসানা নামে এক নারীর। তিনি পরিবারের মোট ৫ জন সদস্য নিয়ে এখানে থাকেন। কারওয়ান বাজারে আড়তে কাজ করে দৈনিক আয় করেন ৩০০-৩৫০ টাকা। চোখে জল এনে কান্না জড়িত কণ্ঠে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ওরা (রেলের কর্মকর্তা) টাকা-পয়সা খেয়ে মুরগি ফার্ম ভাঙে নাই। কিন্তু আমাদের ঘরগুলো ভেঙে দিয়া গেছে। আমরা এখানে যারা থাকি, তাদের কারও থাকার জায়গা নাই দেখেই এখানে থাকি। এখানের কেউ রিকশা চালায়, মানুষের বাসায় কাজ করে।
তিনি বলেন, এই ঘর আবার উঠাতে শুধু কাজের মানুষকে দিতে হবে ৪-৫ হাজার টাকা। এছাড়া পলিথিন, বাঁশ ও টিন কিনতে হবে। সবমিলিয়ে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়ে যাবে। এতো টাকা কোথায় পাবো।
অভিযান শেষে রেলওয়ে ঢাকা বিভাগীয় ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. নাসির উদ্দিন মাহমুদ বলেন, সারা বাংলাদেশে অবৈধভাবে দখল করে রাখা রেলের জমি উদ্ধার করা হচ্ছে। এ বিষয়ে বর্তমান সরকার গত মাসে নোটিশ দিয়েছে। সবাইকে যার যার স্থাপনা সরাতে বলা হয়েছে। না হলে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নিবো। কিন্তু বেশিরভাগই তাদের স্থাপনা সরায়নি। তার প্রেক্ষাপটে আজ আমরা তেজাগাঁও রেলগেট এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেছি। রেলের প্রায় ৫ একর জমি আমরা উদ্ধার করেছি। আমাদের বাকি কর্যক্রম চলমান থাকবে।
আপনি ছোটখাটো স্থাপনাগুলো ভেঙে দিলেন কিন্তু পাশে থাকা আওয়ামী লীগ-বিএনপির নেতাদের মুরগির ফার্ম ভাঙলেন না কেন এবং এই ফার্মের জন্য লোকো মাস্টাররা কার্ভে ভালোভাবে দেখতে পান না। এটি কবে নাগাদ উচ্ছেদ করা হবে— জানতে চাইলে তিনি বলেন, যারা অবৈধ দখলদার, তারা তো চেষ্টা করবেই স্থাপনা ধরে রাখার জন্য। আপনারা নিজেরাই দেখেছেন, একজন পলিটিক্যাল লোকের সাপোর্ট তারা নিয়েছেন। তারা ৩ দিনের সময় নিয়েছে, এরমধ্যে ঘরটা সরিয়ে নেবে। ৩ দিন পর আমি ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করবো। মুরগী ফার্মসহ আশেপাশে যা আছে, সব উচ্ছেদের ব্যবস্থা করবো।
রেলওয়ে সম্পত্তি (অবৈধ দখল উদ্ধার) আইন, ২০১৬ তে ৪ নম্বরে রেলওয়ে সম্পত্তি চুরি, অবৈধ দখল, ইত্যাদির দণ্ড বিষয়ে লেখা আছে, ‘কোনো ব্যক্তি রেলওয়ে সম্পত্তি চুরি করিলে বা অবৈধভাবে অর্জন করিলে বা দখল করিলে উহা একটি অপরাধ হইবে এবং তজ্জন্য তিনি অনধিক ৭ বছর সশ্রম কারাদণ্ড অথবা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’
অপরাধ সংঘটনে সহায়তাকারীর দণ্ড হিসেবে ৫ নম্বরে লেখা আছে, ‘কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীন অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করিলে তিনি অনধিক ৫ বছর সশ্রম কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’ (সৌজন্যে: ঢাকাপোস্ট)