বিমান কর্মচারীসহ গ্রেপ্তার ৫

সেনজেন ভিসায় লোক পাঠানোর নামে প্রতারণা

সেনজেন ভিসায় লোক পাঠানোর নামে প্রতারণা

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে টুরিস্ট ভিসায় সেনজেনভুক্ত দেশগুলোতে পাঠানোর নামে অভিনব প্রতারণা করছে একটি চক্র। তারা টুরিস্ট অথবা ভুয়া ভিসায় গত দেড় বছরে আড়াই শতাধিক মানুষকে মধ্যপ্রাচ্য এবং সেনজেনভুক্ত বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে পাঠিয়েছে। এ জন্য ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে ১৬-১৮ লাখ করে টাকা নিয়েছে চক্রটি। অবৈধভাবে ওইসব দেশে যাওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে জেল খেটে শূন্য হাতে দেশে ফিরতে হয়েছে তাদের।

গতকাল সকালে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনাল-২ এর পূর্ব পাশে অবৈধভাবে জাল ভিসা ব্যবহার করে বিদেশে পাঠানোর পাঁয়তারা করছিলেন কয়েকজন। বিষয়টি টের পেয়ে এপিবিএনের সদস্যরা তাদের নজরদারিতে রেখে ডিবি পুলিশকে খবর দেন। এপিপিএনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যৌথভাবে ডিবি পুলিশ অভিযান চালিয়ে চক্রের দুই হোতা মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান ও মোহাম্মদ কবির হোসেনসহ ৫ জনকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তার অন্যরা হলেন, বিদেশ যেতে ইচ্ছুক যাত্রী জানে আলম, সাব্বির মিয়া ও সম্রাট সওদাগর।

এ সময় তাদের কাছ থেকে জব্দ করা হয় তিনটি পাসপোর্ট, ৩টি জাল ভিসা, ৪টি এনআইডি, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবেশের স্পেশাল কার্ড, ৪টি মাস্টার/ ভিসা কার্ড, ৫টি মোবাইল, ৩টি ই-টিকেট, ওয়ার্ক পারমিট ও ভিসা সংশ্লিষ্ট ৫/৬ পাতা জাল ডকুমেন্ট, ১টি ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং নগদ ১৬ হাজার টাকা।

ডিবি পুলিশ বলছে, আদালতের নির্দেশে এক দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে তাদের। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ৩ যাত্রী স্বীকার করেছেন ১৬ থেকে ১৮ লাখ টাকা দালালদের দিয়ে অবৈধ পথে ফ্রান্স, ইতালি এবং গ্রিসে যাচ্ছিলেন তারা। দুই হোতার বক্তব্যে উঠে এসেছে বাংলাদেশ বিমানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কয়েকজন এ চক্রের সঙ্গে জড়িত আছেন।

বৃহস্পতিবার(২২ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ এসব তথ্য জানান।

তিনি বলেন, মানবপাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ে লাখ লাখ টাকা খোয়াচ্ছে সাধারণ মানুষ। আমরা অনেকবারই বলেছি। বিভিন্ন পন্থায় তারা সেনজেন ভিসাভুক্ত ইউরোপিয়ান দেশগুলোতে যাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। এজন্য সক্রিয় রয়েছে দালাল চক্র। এক সময় দেখা যেত নৌপথে লিবিয়া বা ইউরোপিয়ান দেশ ইতালিতে যাওয়ার পথে অনেকে মারা যেতেন। অনেকে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হতেন। এরপর জেল খাটতেন। কেউ কেউ কাজও পেয়ে যেতেন। এখন এ পন্থায় ইউরোপ যাওয়ার পথ কঠিন হচ্ছে।

তিনি বলেন, এখন নতুন পন্থা অবলম্বন করছে দালাল চক্রের সদস্যরা। বাংলাদেশ বিমানের সিকিউরিটি ম্যান, কুয়েত এয়ারওয়েজের বুকিং সহকারী, কিছু জনশক্তি রপ্তানি প্রতিষ্ঠান ও ট্রাভেল এজেন্সিসহ কম্পিউটার অপারেটর মিলে শক্তিশালী একটি চক্র যারা টুরিস্ট ভিসার কথা বলে সেনজেন ভিসাভুক্ত দেশে কোনো রকম পাঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এরপর পৌঁছে গেলে আর ফেরত আসতে হবে না এই বলে কারো কারো কাছ থেকে ১৬ থেকে ১৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে তারা।

চক্রটির কাজ হচ্ছে, বিমানবন্দরে কোনো রকমে ঢুকিয়ে দেওয়া। ট্রাভেল এজেন্সি টিকিট করে দেয়। ইউরোপিয়ান কোনো দেশে যাওয়ার জন্য সে টিকিট পেয়ে বিমানবন্দরে ঢোকে। বোর্ডিং আনতে গেলে গ্রেপ্তার হওয়া বাংলাদেশ বিমানের সিকিউরিটি ম্যান ও কুয়েত এয়ারওয়েজের বুকিং সহকারী তাদের কাগজপত্র দেখে বলে সব ঠিক আছে। ইমিগ্রেশনেও চেক করা হয় না। বিদেশগামী ভুক্তভোগীরা কিছু না বুঝে ভুয়া বোর্ডিং কার্ড নিয়ে বিমানে উঠে চলে যায়।

হারুন বলেন, এভাবে ফাস্ট ডেসটিনেশন বাংলাদেশ থেকে তারা উড়াল দিলেও অনেক সময় তারা মধ্যবর্তী স্থানে ট্রানজিট পয়েন্টে আটকে যায়। কখনো সর্বশেষ ফ্রান্স, জার্মান অথবা ইউরোপের ডেসটিনেশনে গিয়ে আটক হন। কারণ এসব জায়গায় চেক করতে গিয়ে দেখে ভুয়া। তখন কাউকে দেশে পাঠায়। কাউকে জেলে পাঠায়। যারা জেলে যায় তারা পরবর্তীতে কেউ কেউ কাজও পেয়ে যায়। চক্রের সদস্যরা এই সুযোগটি নেয়। বলে মামলা করে জেল থেকে ছুটে বের হতে পারবেন।

এ প্রতারণায় জড়িত কিছু জনশক্তি রপ্তানি প্রতিষ্ঠান, ট্রাভেলস এজেন্সি, এয়ারলাইন্স ও কম্পিউটার অপারেটর। গতকাল একই কায়দায় লোক পাঠানোর বিষয়টি টের পান এপিবিএন সদস্যরা। পরে এপিবিএন ডিবি পুলিশকে খবর দিলে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ডিবি প্রধান বলেন, ১৬ থেকে ১৮ লাখ টাকা নিয়ে অসাধু চক্রের খপ্পরে পড়ে যারা বিদেশে যাচ্ছে তারা তো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, অনেকেই মানবেতর জীবন যাপন করছেন। আমরা বার বার বলছি, সাবধান করছি। জালিয়াতি বা প্রতারণার খপ্পরে পড়ছি কি-না তা চেক করার জায়গা তো আছে। আমরা চেক করলে, ভেরিফিকেশন করলেই তো বোঝা যায়।

বিমান বাংলাদেশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও জড়িত : সন্দেহ ডিবির

এই কাজে যারা জড়িত তাদের আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তারা বলেছে, এয়ারলাইন্সের সিনিয়র কর্মকর্তা, সিনিয়র স্টেশন ম্যানেজার, সুপারভাইজাররা জড়িত থাকতে পারে। যদি জড়িতই না থাকবে, তাহলে এয়ারলাইন্সের সিনিয়র কর্মকর্তারা কীভাবে অনায়াসে বোর্ডিং পাস দিয়ে দেয়। তাদের সম্পর্কে আমরা খোঁজ-খবর নিচ্ছি। অবৈধ লোকদের ব্যাপারে তারা কেন কঠোর হয় না, টিকিট বোর্ডিং পেয়ে যাচ্ছে, বিদেশেও চলে যাচ্ছে। এটা তো হতে পারে না।

দেড় বছরে আড়াইশ মানুষকে অবৈধভাবে বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়েছে

তিনি বলেন, গ্রেপ্তার পাঁচজনের সঙ্গে কথা বলে আমরা জেনেছি, পুরো চক্র মিলে আড়াইশ মানুষকে টুরিস্ট ভিসায় বিভিন্ন দেশে পাঠিয়েছে। যাদের অনেকে মানবেতর জীবন যাপনের পর দেশে ফিরে এসেছে। কেউ এখনো জেল খাটছে। এই চক্রটির সঙ্গে বিমানের সিনিয়র কর্মকর্তারা জড়িত থাকতে পারেন বলে আমাদের ধারণা। কারণ আড়াইশ লোক বিদেশ যেতে পেরেছে অবৈধ পন্থায়! আমরা অবশ্যই রিমান্ডে নিয়ে সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করব। কারণ এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক মানের কিছু দালাল চক্রের সদস্যরাও রয়েছে। 

জড়িত থাকার প্রমাণ মিললে বিমানের কাউকে ছাড় নয়

এ অপকর্মের সঙ্গে যদি বাংলাদেশ বিমানের ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তা জড়িত থাকেন তাহলে কী ধরনের ব্যবস্থা নেবেন? এমন প্রশ্নের জবাবে হারুন বলেন, বিমান বাংলাদেশের নিয়োগের প্রশ্নফাঁস থেকে শুরু করে অনেক কিছুর ব্যাপারে আমরা তদন্ত করেছি। তদন্তে প্রাপ্ত তথ্যের বাইরে পিছপা হইনি আমরা। তদন্ত শেষ করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। সেই পরিপ্রেক্ষিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে পারব। সূত্র: ঢাকাপোস্ট