ইসরাইলি কারাগারে ফিলিস্তিনি বন্দিদের ওপর মধ্যযুগীয় নির্যাতন
হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির চুক্তির অংশ হিসেবে ইসরাইল ২৫০ জন দণ্ডিত ফিলিস্তিনি বন্দির পাশাপাশি গাজার ভেতর থেকে আটক করা আরও প্রায় ১ হাজার ৭০০ জন গাজাবাসীকে মুক্তি দিয়েছে। যুদ্ধ চলাকালে ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনী তাদের আটক করেছিল এবং দীর্ঘ মাস ধরে কোনো বিচার ছাড়াই কারাগারে রেখেছিল।
দণ্ডিত বন্দিদের মতো নয়, এই আটক ব্যক্তিদের কারও বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনা হয়নি, কিংবা আদালতে তোলা হয়নি। তাদের অধিকাংশকেই ইসরাইলি কারাগারে নিঃসঙ্গভাবে বন্দি অবস্থায় রাখা হয়েছিল।
বৃহস্পতিবার (২৩ অক্টোবর) এক প্রতিবেদনে এ খবর দিয়েছে টাইমস অব ইসরাইল।
ইসরাইল দাবি করেছে, এই আটক ব্যক্তিরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিন্তু মানবাধিকার সংগঠন ও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা অভিযোগ করেছে, ইসরাইলি বাহিনী গাজায় নির্বিচারে অভিযান চালিয়ে অনেক সাধারণ মানুষকে ধরে নিয়ে গেছে তথাকথিত গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে, যাদের অনেকেরই কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না।
মুক্তি পাওয়া বহু বন্দি জানিয়েছেন, কারাগারে তারা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তারা জানিয়েছেন, নিয়মিত মারধর, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, পর্যাপ্ত খাবারের অভাব ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে তাদের।
কারা এসব আটক ব্যক্তি?
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের ইসরাইল আক্রমণের পর শুরু হওয়া যুদ্ধে ইসরাইলি সেনাবাহিনী বিপুল সংখ্যক গাজাবাসীকে আটক করে।
২০০২ সালের ‘অবৈধ যোদ্ধাদের আটক আইন’-এর আওতায় আইডিএফ (ইসরাইলি সেনাবাহিনী) ও শিন বেত (ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা) গাজার ভেতর থেকে এসব মানুষকে আটক করে এবং বিভিন্ন কারাগারে পাঠায়।
তাদের অনেককে আটক করা হয় হাসপাতাল, স্কুল ও আশ্রয়কেন্দ্র থেকে, যেখানে ইসরাইলি বাহিনী হামাসের উপস্থিতির অভিযোগ তোলে। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার দপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আবাসিক ভবন, রাস্তার চেকপয়েন্ট ও চলাচলের সময়ও সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
আটক অবস্থার শর্ত
২০২৫ সালের অক্টোবরের শুরুতে ইসরাইলি কারাগারে ‘অবৈধ যোদ্ধা আইন’-এর আওতায় আটক গাজাবাসীর সংখ্যা ছিল প্রায় ২ হাজার ৬৭৩। মানবাধিকার সংগঠন হামোকেদ জানিয়েছে, সামরিক আটক কেন্দ্রে আরও কয়েকশ মানুষকে বন্দি করে রাখা হয়েছে।
আটক ব্যক্তিদের সাধারণত ছয় মাস মেয়াদে আটকাদেশ দেওয়া হয়, যা নিয়মিত নবায়ন করা হয় জেলা আদালতের মাধ্যমে। এসব শুনানি ভিডিও কনফারেন্সে পাঁচ থেকে দশ মিনিটের মধ্যে শেষ হয়।
বন্দিদের অধিকাংশই জানতেন না কেন তাদের আটক করা হয়েছে; তারা কোনো প্রমাণ দেখতে পাননি, এমনকি আইনজীবী নিয়োগের সুযোগও পাননি। আন্তর্জাতিক রেড ক্রসকেও ইসরাইল তাদের কাছে যেতে দেয়নি। পরিবারের কারও সঙ্গে দেখা বা যোগাযোগেরও অনুমতি ছিল না।
২০২৪ সালের মে মাসে নাগরিক অধিকার সংগঠনগুলোর চাপে সেনাবাহিনী বন্দিদের সঙ্গে আইনজীবীর সাক্ষাতের ব্যবস্থা চালু করে। তবে কেবল যারা হামোকেদ বা অনুরূপ মানবাধিকার সংগঠনের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতেন, তারাই যোগাযোগ করতে পেরেছিলেন। হামোকেদের নির্বাহী পরিচালক জেসিকা মন্টেল জানান, তাদের সংগঠন মাত্র ৫০ জন বন্দির আইনজীবী সাক্ষাৎ নিশ্চিত করতে পেরেছে।
নির্যাতনের অভিযোগ
মুক্তি পাওয়া অনেক বন্দি জানিয়েছেন, আটক অবস্থায় তারা ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
একজন ২৩ বছর বয়সি ট্রাকচালক জানান, ২০২৪ সালের এপ্রিলে গাজার একটি চেকপয়েন্ট থেকে তাকে আটক করা হয়। তাকে মারধর করা হয়, হামাস সদস্য হিসেবে স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করা হয় এবং পরবর্তীতে তাকে ৪৫ দিনের জন্য সামরিক আটক কেন্দ্রে পাঠানো হয়। সেখানে তাকে ‘ডিস্কো রুমে’ নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রচণ্ড শব্দে গান শোনানো হয় এবং ঘুম থেকে বঞ্চিত করা হয়। তিনি জানান, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকার কারণে তার স্ক্যাবিস রোগ হয় এবং বিশ্রাম নেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে।
আরেক বন্দি জানান, খান ইউনুসে তার বাসা থেকে তাকে ধরে নিয়ে মাথায় আঘাত করা হয়, হাতকড়া ও চোখ বেঁধে রাখা হয়, পরে একটি বাসে তোলা হয় এবং আবারও মারধর করা হয়। তাকে ৯৬ দিন ধরে স্দে তেইমান কারাগারে হাতকড়া ও চোখ বাঁধা অবস্থায় রাখা হয়, এমনকি ঘুমানোর সময় বা বাথরুমে যাওয়ার সময়ও হাতকড়া খোলা হয়নি।
এরপর তাকে ওফের কারাগারে স্থানান্তর করা হয়, যেখানে পরিস্থিতি কিছুটা ভালো ছিল। সেখানে দিনে হাতকড়া পরতে হতো, কিন্তু রাতে খুলে দেওয়া হতো। তবে সেখানেও বন্দিদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য সাবানের বদলে মেঝে পরিষ্কারের তরল দেওয়া হতো।
মানবাধিকার সংগঠন হামোকেদ জানিয়েছে, অন্তত ১২ জন গাজাবন্দির কাছ থেকে একই ধরনের নির্যাতনের প্রমাণ পেয়েছে তারা।
ইসরাইলি সেনাবাহিনী ও কারা কর্তৃপক্ষ এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তবে ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন গভির প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন, তিনি ফিলিস্তিনি বন্দিদের ওপর কঠোর নীতিমালা আরোপ করেছেন।
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্দে তেইমান আটক কেন্দ্রে চোখ বাঁধা অবস্থায় বন্দিদের মারধরের দায়ে এক ইসরাইলি রিজার্ভ সেনাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। একই মাসে আরও পাঁচজন রিজার্ভ সদস্যের বিরুদ্ধে একজন ফিলিস্তিনি বন্দিকে নির্মমভাবে নির্যাতনের অভিযোগে মামলা হয়।

