সাক্ষাৎকার : ফরহাদ মজহার

রাজনৈতিক দল ছাড়াই হয়েছে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান, জনগণ বসে থাকবে না

রাজনৈতিক দল ছাড়াই হয়েছে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান, জনগণ বসে থাকবে না

কবি ও রাষ্ট্রচিন্তক ফরহাদ মজহার বলেছেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর জনগণের চাওয়া বা অভিপ্রায় বোঝা এবং তা বাস্তবায়ন নিয়ে কোনো রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখছি না। আওয়ামী লীগ পলাতক, কিন্তু তাই বলে তো জনগণ বসে থাকবে না। জনগণের গঠনমূলক কর্তাসত্তার বিকাশ এখন আমাদের প্রধান রাজনৈতিক কর্তব্য এবং এ কর্তব্য সবার। কিন্তু আমাদের প্রকৃত রাজনৈতিক দল তো নেই। রাজনৈতিক দল মানেই তো আর লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণীর প্রতিনিধি না, নতুন ভাবে লুটপাটের জন্য তাদের ক্ষমতায় বসানোর ব্যাপার না, বরং গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে হাজির হওয়া জনগণের নতুন সামষ্টিক কর্তাসত্তাকে স্বীকৃতি দেয়া এবং তাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক তৎপরতা চালানো, যেন আমরা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নতুন ও সঠিক ভাবে গঠন করতে পারি। নয়া দিগন্তকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।

তাহলে কি বড় ধরনের সঙ্কটে পড়ে গেলাম আমরা?

ফরহাদ মজহার : অফকোর্স! ভীষণ সঙ্কটে পড়ে গেছি।

জুলাই আন্দোলন হলো, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎটা কী?

ফরহাদ মজহার : খুব ভালো। কারণ রাজনৈতিক দলগুলো ছাড়াইতো জুলাই গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে। অতএব জনগণ হতাশ হয়ে ঘরে বসে থাকবে না।

জনগণের মধ্যে যে নতুন রাজনৈতিক কর্তাসত্তার উপলব্ধি ঘটেছে তার বিকাশ ঘটবেই। রাজনৈতিক দলগুলো যদি এই নতুন কর্তাসত্তার শক্তি ও রূপ ধরতে না পারে তাহলে তারা হারিয়ে যাবে। সেনাবাহিনী যদি জনগণকে বুঝতে ভুল করে তাহলে তারা জনগণের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে। রাজনৈতিক দল সেনাবাহিনীর ‘অভিভাবক’ নয়, একমাত্র জনগণই সেনাবাহিনীর বন্ধু এবং মিত্র সেনাবাহিনীকে সেটা বুঝতে হবে। জনগণের চোখে দিল্লির দালাল হিসেবে চিহ্নিত হওয়া হবে মারাত্মক ভুল। ভাবুন, মুসলিম লীগ এক সময় বিশাল রাজনৈতিক শক্তি ছিল তারা হারিয়ে গিয়েছে। আওয়ামী লীগ পলাতক। অনুশোচনা, ক্ষমা প্রার্থনা এবং বিচার ছাড়া নতুন রূপে বা নতুন নামে আওয়ামী লীগের ফিরে আসার সম্ভাবনা নাই। ইতিহাসের বিপরীতে যারাই দাঁড়াবার চেষ্টা করে তারা আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়।

 বন্দরে বড় ধরনের বিনিয়োগের কথা শোনা যাচ্ছে, বিদেশী বিনিয়োগ চাই, ভালো কথা; কিন্তু আমাদের দেশের নিজস্ব উদ্যোক্তাদের বিকাশ কিভাবে হবে?

ফরহাদ মজহার : একদম ঠিক। নিজস্ব বিনিয়োগ কিভাবে হবে তা লম্বা আলোচনার বিষয়। একদিনে বলার বিষয় নয়। প্রথমত এখনকার যে পলিসি, যেটাকে বলে নিউ লিবারেল ইকোনমিক পলিসি মানে কাছাখোলা অবাধ বাজারব্যবস্থা- এটা বদলাতে হবে প্রথম। ইট হ্যাজ টু বি স্ক্র্যাপড ডাউন। ফ্যাসিস্ট সংবিধানের মতো ফালায়া দিতে হবে এবং বাজারব্যবস্থার প্রগতিশীল ও ইতিবাচক দিক বিকাশের জন্য কার্যকর বিনিয়োগ ও জাতীয় বাজার বিকাশের নীতি গ্রহণ করতে হবে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থা ও অর্থনৈতিক বিকাশবিরোধী বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় চুক্তি বাতিল করতে হবে, সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। কাছাখোলা অবাধ বাজারব্যবস্থা দ্বারা আমাদের কোনো অর্থনৈতিক বিনিয়োগ আসবে না। তার জন্য আলাদা বিনিয়োগনীতি দরকার, বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী উদ্যোক্তাদের পাশে শক্তভাবে থাকা দরকার। মানবসম্পদ দ্রুত উন্নয়নের জন্য কার্যকর নীতি দরকার অর্থাৎ শিক্ষা খাতে রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ বাড়াতে হবে, ইত্যাদি। কাছাখোলা অবাধ বাজারব্যবস্থা লুটেরা ও মাফিয়াশ্রেণীর অবাধ শোষণের একটা উপায় মাত্র।

দেখা যায় ঘুরে ফিরে এলিটরাই-।

ফরহাদ মজহার : গণবিচ্ছিন্ন এলিটরাই বাংলাদেশ এখনো সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে। ওরা এখানে কারখানা বসাবে না, কিছুই বসাবে না। আমাদের এখান থেকে জায়গা দখল করে ইপিজেড করবে, সস্তা শ্রম কিনবে, কম দামে কিনে বিদেশে তারা বেশি দামে বিক্রি করবে। আমাদের কোনো উন্নতি হবে না। আমরা কাঁটাতারের বেড়ার মধ্যে সস্তা শ্রম বেচে ধুঁকে ধুঁকে মরতে থাকব।

তো এ কারণেই কি ইপিজেড বাড়ে কিন্তু আমাদের বিসিক শিল্প এলাকা বাড়ে না?

ফরহাদ মজহার : আলবৎ। কেন বাড়ে না? আপনি তো স্থানীয়দেরকে, আমাদের যারা উদ্যোক্তা, ছোট উদ্যোক্তাদের উন্নতির কোনো সুযোগই দিচ্ছেন না। তারা দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। তাদের প্রতি কি নীতি আছে সরকারের? আছে কোনো নীতি? আপনি বিদেশ থেকে বিনিয়োগকারী নিয়ে এসে তাদের এখানে শোষণ করতে দিচ্ছেন। ছোট উদ্যোক্তাদের সমস্যা আপনি তো অ্যাড্রেস করছেন না। বাংলাদেশে তো বিশাল একটা উদ্যোক্তা শ্রেণী আছে। এরা ছোট থেকে মাঝারি। এদের একটু উৎসাহ দিলেই তারা বিরাট বিরাট কোম্পানি বা আধুনিক উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে পারবে। চীনের অভিজ্ঞতা দেখুন। তাদের জন্য অবকাঠামো তৈরি করে দেয়া, তারা যেন ঠিকমতো কাজ করতে পারে, সরকারের সহায়তাটুকু পায়, সেটা করুন।

লাইসেন্সই তো আপনি বাদ দিয়ে দিচ্ছেন। ওরাতো উঠতেই পারছে না কোথাও। একটা লোক যার এক দেড় কোটি টাকা হাতে আছে তাকে তো আপনি সাপোর্ট দেবেন, সে যদি ছোট একটা কারখানা করতে চায়; উৎপাদনমুখী বিনিয়োগ করতে চায়; তো করতে দিন না তাকে। তাকে একটু সাপোর্ট দিতে হবে। আপনি ইউএনওগুলো রেখেছেন তারা এক একজন রাজা বাদশাহ যেন। আমলারাও তাই। ভয়াবহ আমলাতন্ত্র পরজীবী শক্তি হয়ে দেশের উন্নতির প্রধান বাধা হয়ে হাজির। আমলাতন্ত্র ভাঙুন।

তো একদিকে অলিগার্ক শ্রেণী আর ঋণখেলাপির সংস্কৃতি; এর মোকাবেলা কিভাবে করব?

ফরহাদ মজহার : অবশ্যই। আমরাতো গণ- অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে কিভাবে এই শ্রেণী মোকাবেলা করতে হয় দেখিয়ে দিয়েছি। এই শ্রেণীকে উপড়ে ফেলতে হবে। আজকে কোথায় দরবেশ সাহেব, তিনি এখন কি জেলে নাই? এসব লুটেরা শ্রেণীকে জেলে ঢুকাতে কী সমস্যা?

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন তো দীর্ঘদিন ধরে আমরা পারছি না?

ফরহাদ মজহার : রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আর পারবেন না।

 মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছে, তো কেউ কেউ বলছে করিডোর দিলে রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে ফেরত দেয়া যাবে ইত্যাদি।

ফরহাদ মজহার : এটা মিথ্যা কথা। এটার নেতিবাচক ফল তো আমরা সিরিয়ায় দেখেছি। সিরিয়ার অভিজ্ঞতা পরিষ্কার বলে যে, করিডোর আমাদের জন্য আত্মঘাতী হবে। রোহিঙ্গা ইস্যু এখন আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে প্রক্সি ওয়ারে জড়ানো ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে।

খুব দ্রুততার সাথে দেশে ইন্টারনেট খাতে ইলন মাস্কের স্টারলিংক স্যাটেলাইট-ভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা এসে গেছে। অনেকে এ বিনিয়োগকে তথ্যসন্ত্রাস বা সার্বভৌমবিরোধী হতে পারে বলে শঙ্কা করছেন।

ফরহাদ মজহার : জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরে দেশে বিদ্যমান ইন্টারনেটসেবার মানোন্নয়নের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা না নিয়ে ইলন মাস্কের স্টারলিংক স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা বাংলাদেশে আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা উৎখাত করে সবকিছু স্বচ্ছ ও জনগণের জবাবদিহিতার অধীনে আনার জন্য। কেন? যেন বাংলাদেশের জনগণ প্রযুক্তিগত জ্ঞান দ্রুত আয়ত্ত করতে পারে, প্রযুক্তির স্থানান্তর দ্রুত ও ত্বরান্বিত হয়, বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশলে নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধি দ্রুততর হয়, সর্বোপরি নিজেরা আবিষ্কার করার অবকাঠামোগত পরিবেশ এবং বিজ্ঞান চর্চার ভিত্তি দ্রুত তৈরি হয়, ইত্যাদি।

কিন্তু জনগণ দেখছে, ড. ইউনূস জনগণের ক্ষমতা জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ না নিয়ে রাষ্ট্রকে আবারো পুরনো ফ্যাসিস্ট সংবিধান এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মধ্যে বেঁধে ফেললেন। সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কারের কোনো পদক্ষেপ তিনি নিলেন না। অথচ ক্ষমতা পেয়েই বাংলাদেশের জনগণকে ক্ষমতাবান না করে সব কিছু ‘আউটসোর্সিং’ করতে শুরু করে দিয়েছেন।

তার উচিত ছিল আমাদের অর্থনৈতিক বিকাশের বাধা ও চ্যালেঞ্জ এবং দীর্ঘ ফ্যাসিস্ট ও আমলাতান্ত্রিক শাসনের ফলে সৃষ্ট গভীর ক্ষত ও সঙ্কটগুলো আগে শনাক্ত করা। দরকার ছিল অল্প কয়েকটি বহুজাতিক করপোরেশান ও শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর বিপরীতে বাংলাদেশকে শক্তিশালী করবার পথ আগে অনুসন্ধান করা। আন্তর্জাতিক শোষণের কাছাখোলা ময়দান থেকে পোস্ট-কলোনিয়াল বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে বের হয়ে আসার নীতি ও কৌশল নির্ণয় করা। জনগণের সাথে ব্যাপক আলোচনা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকদের কাছ থেকে সম্মতি আদায়ের প্রক্রিয়া শুরু ও শেষ করা। তিনি তা করছেন না। এতে জনগণ মনে করতে শুরু করেছে তিনিও চরম একনায়কতান্ত্রিক ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার মতো একাই সব সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করেছেন।

ড. ইউনূসতো বলছেন চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশী বিনিয়োগ হলে ২০৩৬ সাল নাগাদ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে বন্দরের সাথে সংশ্লিষ্টরা বিশ্বের অনেক বন্দর পরিচালনা করার সুযোগ পাবেন?

ফরহাদ মজহার : চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার দ্বারা শৃঙ্খলিত। চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের সার্বিক রাজনৈতিক অবস্থা ও অর্থনৈতিক নীতি দুর্দশায় আক্রান্ত। বিশেষত মাফিয়া ও লুটেরা শ্রেণীর লুটপাটের জাল থেকে মুক্ত নয়। অথচ তার কথায় মনে হয় বন্দর বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন মাল খালাস করবার জেটি বা টার্মিনাল মাত্র। আসল কাজ রেখে বিচ্ছিন্ন ভাবে চট্টগ্রাম বন্দর নামক হৃৎপিণ্ডের অসুখ বড় ‘ডাক্তার’ দিয়ে চিকিৎসা করতে চান। বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানি নাকি কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ‘হৃৎপিণ্ড’ বানিয়ে দেবে। তার মতো একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মানুষ এই সব হাস্যকর যুক্তি দিয়ে বন্দর আউটসোর্সিং করার নীতি আরোপ করার কথা বলছেন। আমরা লজ্জিত।

বন্দর ব্যবস্থাপনা আউটসোর্সিংয়ের উদাহরণ হিসেবে যেসব দেশের ফিরিস্তি দেয়া হচ্ছে সেই সব দেশ সবার আগে তাদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামো ঠিক করেছে। অনেকে পূর্ণ রাজনৈতিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে গিয়েছে যেন জনগণ নিজেদের স্বার্থের দিক নিজেরা রক্ষা করতে পারে। তারা বন্দর ইজারা দিয়েছে বটে কিন্তু নিজেদের রাষ্ট্রীয় ভাবে গঠন বা নিদেন পক্ষে সংস্কারের কাজ আগে করেছে। সর্বোপরি জনগণের কাছে সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করেছে। এমনকি টেকনোলজি ও ব্যবস্থাপনার দক্ষতা ট্রান্সফার এবং কর্মসংস্থানের নীতিও তারা আগে প্রণয়ন করেছে।

ড. ইউনূস তো কর্মসংস্থানের কথা বলছেন।

ফরহাদ মজহার : ড. ইউনূস তো কর্মসংস্থানের নীতিতে বিশ্বাস করেন না। তিনি ঘোষণা করেছেন, কেউ যেন ‘জব’ বা চাকরি না খোঁজে, সবাই শুধু ব্যবসা করুক। ড. ইউনূসকে বলব, আসুন, আগের কাজ আগে করি। যেসব দেশের কথা তিনি বলছেন, তারা আগে বিপ্লব কিংবা রাষ্ট্রের সংস্কার করেছে। অথচ আমরা এত বড় গণ-অভ্যুত্থানের পরও রাষ্ট্রের কোথাও কোনো আঁচড় লাগাতে পারিনি। শেখ হাসিনার সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়েছি এবং চরম দুর্নীতিবাজ আমলাতন্ত্র টিকিয়ে রেখেছি। ড. ইউনূস বাংলাদেশকে আগে নতুনভাবে গঠনের কাজ করছেন না। বিপরীতে তিনি বিদ্যমান বিশ্ববাজারের খোলা ময়দানে বাংলাদেশকে বড় বড় কোম্পানি ও বৈশ্বিক মহাজনদের কাছে বেচাবিক্রি শুরু করে দিয়েছেন। জনগণ এর জন্য শহীদ হয়নি কিংবা সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেনি। বাংলাদেশের সামষ্টিক উন্নতির কোনো সুস্পষ্ট নীতিমালা ছাড়া কাছাখোলা কায়দায় বিদেশী করপোরেট স্বার্থের কাছে বন্দরসহ বিভিন্ন অবকাঠামো ছেড়ে দেয়া মোটেও ঠিক নয়। বাংলাদেশের স্বার্থ কোথায় আগে সে বিষয়ে জনগণকে কথা বলতে দিন, সামষ্টিক স্বার্থের কথা বলুন। আউটসোর্সিং করলে জনগণের কী উপকার তা সঠিক পরিসংখ্যান ও তথ্যের ভিত্তিতে প্রমাণ করুন।

বিনিয়োগের জন্য ড. ইউনূস তাহলে দেশী বিনিয়োগকারীদের আগে বেছে নিচ্ছেন না কেন?

ফরহাদ মজহার : তার দৃষ্টিভঙ্গির পেছনে যে মতাদর্শিক কারণ বা অন্ধ বিশ্বাস কাজ করে সেটা হলো বাংলাদেশের জনগণের ক্ষমতা ও সম্ভাবনায় গভীর অবিশ্বাস। ড. ইউনূস আসলেই বিশ্বাস করেন বাংলাদেশের কোনো ‘হৃৎপিণ্ড’ নাই। থাকলেও সেটা হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর। কিন্তু সেই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া এখন বন্ধ। হার্টফেলের জোগাড়। আমরা হৃৎপিণ্ডের অসুখে ভুগছি , অতএব বিদেশ থেকে বড় বড় ডাক্তার এনে আমাদের হৃৎপিণ্ডের চিকিৎসা করতে হবে আগে। চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে তার হৃৎপিণ্ড স্টোরি আমাদের চরমভাবে হতাশ করেছে।

আমরা মনে করি বন্দর ব্যবস্থাপনাকে অবশ্যই দক্ষ করে তুলতে হবে। এই ক্ষেত্রে তার সাথে আমরা একমত। চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে শুধু বাংলাদেশ নয়, উত্তর-পূর্ব ভারতের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও জড়িত। তার এই দাবির সাথেও আমরা একমত। তাহলে সবার আগে বন্দর অব্যবস্থাপনার মূল কারণগুলো চিহ্নিত করে জনগণকে সেটা জানাতে হবে। তিনি সেটা করেননি। শুধু তাই না। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার জন্য অস্থির হয়ে গিয়েছেন। এতে তার ভাবমূর্তি মারাত্মক ভাবে ক্ষুণœ হবে।

তাহলে ড. ইউনূস কি বিনিয়োগের জন্য উল্টোরথে চড়ে বসেছেন?

ফরহাদ মজহার : জুলাই গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে জনগণের ক্ষমতা জনগণের হাতে ফিরিয়ে আনার জন্য। স্রেফ ‘রেজিম চেইঞ্জ’-এর জন্য নয়। রক্ত দিয়ে যারা বাংলাদেশ মুক্ত করেছে তাদের কোনো কিছু না জানিয়ে কোনো তর্কবিতর্ক আলাপ আলোচনা ছাড়া বন্দর ইজারা দেয়া জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের স্পিরিটের সম্পূর্ণ বিরোধী। চরম দুর্নীতিবাজ ফ্যাসিস্ট সরকারের দুর্নীতির নতুন পরিকল্পনা ছিল চট্টগ্রাম বন্দর ইজারা দেয়া, ফ্যাসিস্ট শক্তিকে আমরা উৎখাত করেছি, কিন্তু তার ভূত এসে আমাদের মাথায় চেপে বসেছে।

 চট্টগ্রাম বন্দরে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনেকে ভূকৌশলগত নিরাপত্তার কথা বলছেন, এক্ষেত্রে আমাদের নীতিমালা কী?

ফরহাদ মজহার : আমাদের কোনো জাতীয় বন্দর নীতিমালা নাই। জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতিতে চট্টগ্রাম বন্দরের সামরিক গুরুত্ব অপরিসীম। ভুরাজনৈতিক বিপদ সম্পর্কে কোনো অর্থপূর্ণ জাতীয় আলোচনা নাই। গণসম্মতি এবং জবাবাদিহিতার ব্যবস্থা গড়ে তোলার কোনো ব্যবস্থা নাই। এই বাস্তবতায় চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশী করপোরেট স্বার্থের হাতে ছেড়ে দেয়া গণস্বার্থবিরোধী কাজ হবে। চট্টগ্রাম বন্দর শুধু অর্থনৈতিক ইস্যু না, একই সাথে সামরিক ও জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন। তা ছাড়া চট্টগ্রামকে বঙ্গোপসাগর ও তিন নদীর মোহনায় বিশ্বসেরা বঙ্গোপসাগরীয় বন্দর-শহর হিসেবে গড়ে তুলতে হলে আমাদের প্রচুর কাজ আগাম সম্পন্ন করে আসতে হবে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান আমাদের সেই সুযোগ করে দিয়েছে। এই সুযোগ আমরা হেলায় হারাতে চাই না।

দীর্ঘদিন ধরেই তো চট্টগ্রাম বন্দরের সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে?

ফরহাদ মজহার : চট্টগ্রাম বন্দরে অদক্ষতার জন্য প্রধানত কাস্টমস দায়ী অর্থাৎ রাজস্ব বিভাগের আমলা এবং বন্দরের রাজস্ব ব্যবস্থাপনা দায়ী এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি। জাহাজ থেকে মাল ওঠানামার ক্ষেত্রে যে সময়ের দরকার সেই সময় ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দরের মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ের। ইতোমধ্যেই বন্দর ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দক্ষতা প্রচুর বেড়েছে এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থান বিপুল গণপ্রেরণাও সৃষ্টি করেছে। এই ক্ষেত্রে অবশ্যই বন্দর শ্রমিকদের অবদান রয়েছে। কাস্টমস ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসন করলে বাংলাদেশই বিশ্বের সেরা বন্দর ব্যবস্থাপনার প্রমাণ দিতে সক্ষম। কিন্তু বিগত ফ্যাসিস্ট শক্তির আমলে সেটা করতে দেয়া হয়নি। তাহলে ড. ইউনূস কি ফ্যাসিস্ট শক্তির পদাঙ্কই অনুসরণ করতে চাইছেন?

চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনা আউটসোর্সিং হলে বাংলাদেশের বন্দর ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা অর্জনের প্রক্রিয়া মারাত্মক বিঘিœত হবে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরে সেটা হবে বাংলাদেশের স্বার্থ ক্ষুণœ করে নির্বিচারে বিদেশী করপোরেট স্বার্থের পক্ষে দাঁড়ানো। স্বচ্ছ আলোচনা পরিহার, জনমত উপেক্ষা করা এবং বিদেশী বন্দর অপারেটর মানেই ভালো এই ভুয়া দাবির ভিত্তিতে চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশী অপারেটরদের হাতে তুলে দেয়া কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।

জুলাই আন্দোলনের পর বিভিন্ন সংস্কার দাবির মতো অন্যতম দাবি ছিল পুলিশের সংস্কার, কিন্তু বলা হলো আমলাতান্ত্রিক সংস্কারের মাধ্যমে পুলিশের সংস্কার হবে। তার মানে কি রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় এসে ফের পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের পথ খোলা রাখছে?

ফরহাদ মজহার : ৫ আগস্টের পর থেকে আমাদের সমাজে যেসব দাবিদাওয়া নিয়ে জনগণকে আমরা মাঠে সোচ্চার হতে দেখেছি তার অধিকাংশই আমলাতান্ত্রিক, পুলিশি ব্যবস্থা এবং নিয়ন্ত্রণবাদী রাষ্ট্রের বিপরীতে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগঠনের আকাক্সক্ষা থেকে গড়ে উঠেছে। আমলা কিংবা লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণী নয়, জনগণের গঠনমূলক কর্তাসত্তার বিকাশই এখন আমাদের প্রধান রাজনৈতিক কর্তব্য। সেই কর্তাসত্তা নির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হওয়া, তাদের স্বার্থ ও দাবিদাওয়া কোথায় এবং কিভাবে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সামষ্টিক স্বার্থের সাথে যুক্ত আমাদের তা বুঝতে হবে।

সমাজে উত্থাপিত বিভিন্ন দাবিদাওয়া ও সংগ্রামের মর্ম আমাদের অনেকের কাছেই স্পষ্ট নয়। তাই এসব দাবিদাওয়া এবং জনগণের ন্যায্য সংগ্রামকে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরে গণসার্বভৌমত্বের আলোকে আমাদের নতুনভাবে বুঝতে হবে। জনগণের সামষ্টিক স্বার্থের দিকগুলো আমাদের শনাক্ত ও সমর্থন করা শিখতে হবে। জ্ঞানোৎপাদকে আমলাতান্ত্রিক ও পুলিশি নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর অতিশয় জরুরি হয়ে পড়েছে।