সিলেটে বন্যায় ইটনা-মিঠামইন সড়ক কতটুকু দায়ী?
সিলেটের সাম্প্রতিক বন্যার জন্য অলওয়েদার সড়ক খ্যাত কিশোরগঞ্জের ইটনা-মিঠামইন সড়ক কতটুকু দায়ী-এ নিয়ে সিলেটের সচেতন মহলে নানামুখী আলোচনা চলছে। সোস্যাল মিডিয়া ফেইসবুকেও সিলেট অঞ্চলে দফায় দফায় ভয়াবহ বন্যার জন্য এ সড়ককে দায়ী করা হচ্ছে। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় ভয়াবহ বন্যার জন্য বিজ্ঞানীরা জলবায়ুর পরিবর্তনকে দায়ী করলেও তারা বলছেন হাওর এলাকায় মানুষের নানা ধরনের অবকাঠামো তৈরির কারণে সেখানকার পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। হাওরে অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন না করলে আগামীতে সিলেট অঞ্চলের মানুষকে আরো ভয়াবহ পরিণতির মুখোমুখি হতে বলে বলে আশংকা প্রকাশ করেছেন বিজ্ঞানীরা।
যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন ইউনিভার্সিটি এবং বাংলাদেশে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের যৌথ গবেষণায় উঠে এসেছে, সিলেট অঞ্চলের বর্তমান বন্যার পেছনেও বড় কারণ প্লাবন-ভূমি এবং হাওরের ওপর মানুষের হস্তক্ষেপ। এই গবেষণায় যুক্ত রয়েছেন পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির ড. আরিফ মাসরুর এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহবুব মোর্শেদ।
এ বিষয়ে ড. মাহবুব মোর্শেদ বলেন, উজান থেকে আসা পলিতে সিলেট অঞ্চলের নদ-নদীগুলোর তলদেশ ভরাট হচ্ছে। চেরাপুঞ্জি ও সিলেট অঞ্চলে অল্প সময়ে প্রচুর বৃষ্টিপাত হচ্ছে। নদ-নদীগুলোও ড্রেজিং হচ্ছে না। হাওরাঞ্চলে নির্মাণ করা হচ্ছে অবকাঠামো। এসব কার্যক্রমের ফসল হচ্ছে বাইশ সালের পর থেকে সিলেট অঞ্চলের ভয়াবহ বন্যা। তিনি বলেন, হাওর হচ্ছে পানি ধারণের আঁধার। হাওর এমনিতে সুন্দর। হাওরের বুকে অলওয়েদার সড়ক নির্মাণের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তার। হাওরে রাস্তা নির্মাণের ফলেই সিলেটে বর্তমানে পানি নামার গতি ধীর। হাওরে রাস্তা বানালে যে তা গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়-সিলেটের সাম্প্রতিক বন্যা এর প্রমাণ। হাওরের পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীবন যাত্রার সাথে সামঞ্জস্য রেখে হাওরে অবকাঠামো নির্মাণের পরামর্শ তাঁর।
সুরমা-কুশিয়ারা নিয়ে গবেষণারত অধ্যাপক মাহবুব মোর্শেদ আরো বলেন, বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থাপনায় সুরমা-কুশিয়ারা-মেঘনা বেসিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই বেসিনের উজানে পৃথিবীর সবচাইতে বৃষ্টিবহুল চেরাপুঞ্জির অবস্থান। চেরাপুঞ্জির পানি সিলেট বেসিন দিয়েই বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করে। সিলেট বেসিনের পানি সুনামগঞ্জের হাওর দিয়েই মেঘনায় প্রবেশ করে। এই পানি দ্রুত প্রবাহিত হতে পারে না। এ পানি হাওরে অবস্থান করে। হাওরে পানি ধারণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকলে নদ-নদীগুলো ওভার ফ্লো হবে না। কিন্তু, অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে আমরা পানির এ প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করছি। অতীতে সিলেট অঞ্চলে এমন বন্যার রেকর্ড নেই বলেও মন্তব্য এ অধ্যাপকের।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) পরিবেশ ও পুর প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. জহির বিন আলমের মতে, ইটনা-মিঠামইন সড়ক পানির প্রবাহকে বাধা দিচ্ছে-এটা ঠিক। তবে, সিলেটের বন্যার জন্য মেইনলি এ সড়ককে ঢালাওভাবে দায়ী করা যাবে না। সড়কটিকে পুরোপুরি দায়ী করতে হলে কিশোরগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের হাইড্রোলজি স্টাডি করতে হবে। স্যাটেলাইটে নদী পর্যবেক্ষণের বিষয়ে আলোকপাত করে তিনি বলেন, ডাউনস্ট্রিমে সুরমা নদী অনেকটা ভরাট হয়ে গেছে।
সুনামগঞ্জের ছাতকের পর নদী একেবারে সমতল। যে কারণে সিলেট অঞ্চলের বন্যার পানি ধীর গতিতে নামছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), সিলেট চ্যাপ্টারের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, সিলেটে বন্যার পেছনে ইটনা-মিঠামইন সড়কের ভূমিকা রয়েছে। তিনি বলেন, হাওরের পানি প্রাকৃতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। হাওরে নদীর কোন সীমানা নেই। তার অভিযোগ, পরিবেশগত সমীক্ষা ছাড়াই এ সড়কটি নির্মিত হয়েছিল। এই সড়কে বন্যার কোন প্রভাব নেই-তা বলা যাবে না। যে কোন ধরণের প্রতিবন্ধকতাই বন্যার কারণ হতে পারে বলে তার মন্তব্য।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিলেটের একজন প্রকৌশলী জানান, সিলেটের পানি সুনামগঞ্জ-কিশোরগঞ্জ হয়ে মেঘনা অববাহিকায় গিয়ে প্রবাহিত হয়। ইটনা-মিঠামইন সড়কের গতিপথে পানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ওই প্রকৌশলী বলেন, ইটনা-মিঠামইন সড়কের দৈর্ঘ্য ৩০ কিলোমিটার। কিন্তু, বর্তমানে সেখানে ৯শ’ মিটার এলাকা দিয়ে হাওরের পানি প্রবাহিত হচ্ছে-যা পানি প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করছে।
সম্প্রতি সিলেটের বন্যা কবলিত এলাকা পরিদর্শনকালে এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক বলেন, “কিশোরগঞ্জের মিঠামইনের সড়কটি পানি প্রবাহে বাধার সৃষ্টি করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজনে সড়কটি কেটে পানি প্রবাহের গতিপথ সহজতর করা হবে বলে জানান তিনি।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, সিলেটের বন্যা নিয়ন্ত্রণের করণীয় নির্ধারণে বুয়েটের ওয়াটার এন্ড ফ্ল্যাড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের সাথে তারা কাজ করছেন। তবে, এ ব্যাপারে সিটি কর্পোরেশন, পানি উন্নয়ন বোর্ড, সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং এলজিইডি’র সমন্বিত পদক্ষেপের ওপর জোর দেন তিনি।
চলতি বছরে টানা দ্বিতীয়বারের মতো বন্যায় আক্রান্ত সিলেট। এর আগে ২০২২ সালে সিলেটে স্মরণকালের ভয়াবহতম বন্যা হয়। এতে পুরো বিভাগের প্রায় ৭০ শতাংশ পানিতে তলিয়ে যায়।
তাদের দাবি, সিলেটে আগেও এরকম প্রচুর বৃষ্টি হতো। কিন্তু এমন বন্যা হতো না। এখন কিশোরগঞ্জের এই সড়কটির কারণে সিলেটের বৃষ্টি ও ঢলের পানি হাওর দিয়ে নদীতে নামতে পারছে না। ফলে পানি আটকে বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে।
হাওরের বিশাল জলরাশির বুক চিরে ৮৭৪.০৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৯.৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ আলোচিত এই সড়কটি নির্মিত হয় ২০২০ সালে। হাওরের তিন উপজেলার যোগাযোগ সহজতর করার পাশাপাশি এই সড়কটি পর্যটকদের কাছেও আকর্ষণীয়।
২০২২ সালে সিলেটের বন্যার পরও আলোচনায় উঠে আসে এই সড়কটি। তখন মন্ত্রীসভায়ও আলোচনা হয়েছে এই সড়ক নিয়ে। হাওরের বন্যায় এই সড়কের কোন প্রভাব রয়েছে কি-না তা খতিয়ে দেখতে বলে মন্ত্রীসভা।
এরপর পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাতের নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, “কিশোরগঞ্জের এই সড়কটি সিলেট বন্যার কারণ বলে মনে হয় না। এখনও সেই সড়কের প্রভাব তেমন পড়েনি। তবে হাওরে এই ধরনের সড়ক নির্মাণের ক্ষতিকর প্রভাব তো রয়েছেই। ভবিষ্যতে এই প্রভাব পড়তে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “এই সড়কের কারণে কয়েক বছর পর ওই এলাকার হাওর ও বিল ভরাট হয়ে যেতে পারে। তখন সিলেট অঞ্চলে প্রভাব পড়বে। সিলেট শহর রক্ষার জন্য নদীর তীরে বাঁধ প্রয়োজন।”
বিভাগের প্রকৌশলীরা জানান, সিলেটের পানি দুই-তিনটি নদী দিয়ে নামে। একটি হলো সুরমা ও পুরাতন সুরমা হয়ে নামে ধনু দিয়ে। সুনামগঞ্জের পানিও এই নদী দিয়ে নামে। নদীটির অবস্থান অলওয়েদার সড়কের সমান্তরালে। সিলেট অঞ্চলের আরেক নদী কুশিয়ারা হাওরে এসে হয়েছে কালনী নদী। এটি সড়কের আরেক পাশ দিয়ে নামে। ফলে অল ওয়েদার সড়ক পানি নামতে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না।
গতবছর পরিকল্পনামন্ত্রী থাকাকালে এক অনুষ্ঠানে সুনামগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য এমএ মান্নান হাওরের এসব সড়ক নির্মাণ ভুল ছিল বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, “হাওরের মাঝখানে সড়ক নির্মাণ করা ঠিক হয়নি। এখন টের পাচ্ছি, হাওরে সড়ক নির্মাণ করে নিজেদের পায়ে কুড়াল মেরেছি। হাওরে সড়ক বানিয়ে উপকারের চেয়ে অপকারই হয়েছে।”
এ ব্যাপারে গত বৃহস্পতিবার এম এ মান্নান বলেন, “সিলেটে বন্যার জন্য এই সড়কই দায়ী- এমনটি বললে সরলীকরণ হয়ে যাবে। হাওরে এমন অসংখ্য স্থাপনা হয়েছে। তাছাড়া মিঠামইন সড়কের দূরত্ব সিলেট ও সুনামগঞ্জ থেকে অনেক দূর।”
তিনি বলেন, “এখন থেকে হাওরে আর কোন সড়ক নির্মাণ করা হবে না, শুধু উড়াল সেতু নির্মাণ করা হবে।”
তিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় যা বলা হয়েছে- যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া এবং বাংলাদেশের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ গবেষণার হিসেবে দেখা গেছে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় আট কোটি ৭০ লাখ মানুষ সরাসরি বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে – যারা নদ-নদীর দুই কিলোমিটার এলাকার মধ্যে বসবাস করে।
আর যারা ঘন ঘন বন্যা বা অতিবন্যায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন তাদের সংখ্যা প্রায় আড়াই কোটি।
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় ভয়াবহ বন্যার জন্য বিজ্ঞানীরা বলছেন, সিলেট অঞ্চলে নদ-নদীর দুই কিলোমিটার এলাকার মধ্যে মানুষের কর্মকান্ড অত্যধিক বেড়ে গেছে।
তারা বলছেন নদীর অববাহিকায়, প্লাবন-ভূমি ও হাওর এলাকায় বসত-ভিটাসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণের কারণে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে।
“এর ফলে বন্যার পানি একবার জনবসতিতে ঢুকলে সেটা আর বের হতে পারছে না, আর সেকারণে বন্যা প্রলম্বিত হচ্ছে – যার ফলে মানুষের দুর্দশা এবং সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বৃদ্ধি পাচ্ছে,” বলেন তিনি।
তিনি বলেন, এর সঙ্গে যখন স্থানীয় বৃষ্টিপাত যোগ হয় তখন পরিস্থিতির আরো মারাত্মক রূপ নেয়। এবার সিলেটে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত ১৭ জুন থেকে সিলেট অঞ্চলে এবার দ্বিতীয় দফা বন্যা দেখা দেয়। সুত্র: সিলেটের ডাক