স্থানীয় সরকার নির্বাচন

যুক্তরাজ্যে ৪০ বছরের ইতিহাসে এমন বিপর্যয়ে পড়েনি সুনাকের কনজারভেটিভ পার্টি

যুক্তরাজ্যে ৪০ বছরের ইতিহাসে এমন বিপর্যয়ে পড়েনি সুনাকের কনজারভেটিভ পার্টি

যুক্তরাজ্যের ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে গত বৃহস্পতিবার স্থানীয় সরকারের ১০৭টি কাউন্সিল ও ১টি সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনে চরম বিপর্যয় ঘটেছে ঋষি সুনাক নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল কনজারভেটিভ পার্টির। এই নির্বাচনে বড় ধরনের জয় পেয়েছে প্রধান বিরোধী দল লেবার পার্টি। রাজনৈতিক দল হিসেবে তৃতীয় অবস্থানে থাকা লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি কনজারভেটিভ পার্টিকে টপকে দ্বিতীয় অবস্থান দখল করে নিয়েছে। গত ৪০ বছরের ইতিহাসে কনজারভেটিভ পার্টি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এমন বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি।

আজ শনিবার স্থানীয় সময় বেলা ২টা পর্যন্ত ১০৭টি কাউন্সিলের মধ্যে ১০৩টি কাউন্সিলের ফলাফল প্রকাশিত হয়। সবশেষ ফলাফলে দেখা যায়, স্যার কিয়ার স্টারমারের লেবার পার্টি ১ হাজার ৬১টি কাউন্সিলর পদে জয় লাভ করেছে। ৫০৮টি কাউন্সিলর পদে জয় পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি। ৫০৪ কাউন্সিলর পদ নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি। এ ছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়লাভ করেছেন ২২৫, গ্রিন পার্টি ১৭৩ ও রেসিডেন্স অ্যাসোসিয়েশন ৪৮টি কাউন্সিলর পদে বিজয়ী হয়েছে।

ব্ল্যাকপুল সাউথ সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনে লেবার পার্টির প্রার্থী ক্রিস ওয়েব ১০ হাজার ৮২৫ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ পার্টির ডেভিড জোনসের প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা ৩ হাজার ২১৮।

নির্বাচনী ফলাফলে হতাশা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে লেবার পার্টি বড় জয় পেলেও আগামী জাতীয় নির্বাচনে জনগণ কনজারভেটিভ পার্টিকেই ভোট দেবে। কারণ, কনজারভেটিভ পার্টি আলোকিত ব্রিটেন গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করছে।

এদিকে লেবার পার্টির নেতা স্যার কিয়ার স্টারমার নির্বাচনী ফলাফলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে ঋষি সুনাককে উদ্দেশ্য করে আগাম জাতীয় নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচনের ঠিক আগমুহূর্তে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জনগণ জানিয়ে দিয়েছেন তাঁরা পরিবর্তন চান।

বৃহস্পতিবার লন্ডন শহরের মেয়র নির্বাচনসহ ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের এই নির্বাচনে সকাল ৭টা থেকে একটানা রাত ১০টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ চলে। এরপর শুরু হয় ভোট গণনা ও ফলাফল প্রকাশ। 

তৃতীয়বারের মতো লন্ডনের মেয়র হলেন সাদিক খান

টানা তৃতীয়বারের মতো লন্ডনের মেয়র নির্বাচিত হয়ে রেকর্ড গড়েছেন সাদিক খান। অপরাধ দমন ও বিশুদ্ধ বায়ুর প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি জয়লাভ করেছেন।

৪৩.৭ শতাংশ ভোট পেয়ে জিতেছেন লেবার পার্টির প্রার্থী সাদিক খান। তার প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ পার্টির সোসান হল পেয়েছেন ৩২.৬ শতাংশ ভোট।

২০১৬ সালে লেবার পার্টি থেকে প্রথমবার লন্ডনের মেয়র নির্বাচিত হন সাদিক খান। পরে ২০২১ সালে দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হন তিনি।

কনজারভেটিভ দলের প্রতিদ্বন্দ্বী হলের বিরুদ্ধে তুমুল প্রচারণার মাধ্যমেই সাদিক খান জয়লাভ করেছেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এমনকি লন্ডনের সাবেক মন্ত্রী পল স্কুলিসহ আরও হাইপ্রোফাইল টরি প্রার্থীদের পেছনে ফেলেই নির্বাচিত হয়েছেন তিনি।

পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত সাদিক খান সুযোগ-বঞ্চিত পরিবারের ছেলে। সাদিক খান তার বাপ-মায়ের আট সন্তানের একজন। পাকিস্তান থেকে আসা সাদিক খানের বাবা ছিলেন বাস ড্রাইভার এবং মা জীবিকা নির্বাহের জন্য সেলাইয়ের কাজ করতেন।

তারা থাকতেন দক্ষিণ লন্ডনের একটি এলাকায় দরিদ্রদের জন্য তৈরি সরকারি কাউন্সিল ফ্ল্যাটে।

ছোটবেলা থেকেই সাদিক খান নিজে যে আদর্শে বিশ্বাসী তা নিয়ে লড়তে এবং সাফল্যের জন্য সব প্রতিকূলতার মোকাবেলা করতে পিছপা হননি।

সাদিক খানের বাবা আমানুল্লাহ খান এবং মা সেহেরুন খান পাকিস্তান থেকে লন্ডনে আসেন ১৯৭০ সালে- সাদিক খানের জন্মের কিছুদিন আগে।

সাদিক খান তাদের আট ছেলেমেয়ের মধ্যে পঞ্চম। তারা সাত ভাই এবং এক বোন। দক্ষিণ পশ্চিম লন্ডনের যে তিন-কামরার ফ্ল্যাটে তারা থাকতেন, সেখানে তাদের বড় পরিবারকে গাদাগাদি করে থাকতে হতো।

স্থানীয় একটি সরকারি স্কুলে তিনি পড়তেন এবং সেখানেই ১৫ বছর বয়সে তিনি রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং লেবার পার্টিতে যোগ দেন। আর্নেস্ট বেভিন কলেজ নামে ওই স্কুলের প্রধান ছিলেন যুক্তরাজ্যের কোনো মাধ্যমিক স্কুলের প্রথম মুসলমান প্রধান শিক্ষক।

সাদিক খান ছোটবেলা থেকেই মুসলিম ধর্মবিশ্বাসকে লালন করেছেন এবং তিনি বলেছেন বাবা-মার কাছ থেকে এই শিক্ষা তিনি পেয়েছিলেন যে ‘কোথাও অন্যায় কিছু দেখলে তা পরিবর্তনের চেষ্টা করা তোমার কর্তব্য।’

তিনি লেখাপড়ায় ভাল ছিলেন, ফুটবল, বক্সিং এবং ক্রিকেট অনুরাগী ছিলেন। এমনকী তরুণ হিসেবে তিনি সারে কাউন্টি ক্রিকেট দলেও কিছুদিন ট্রেনিং নিয়েছিলেন।

তবে তিনি বলেছেন ফুটবল মাঠে কীভাবে তাকে ও তার ভাইকে বর্ণবাদী মন্তব্য শুনতে হয়েছে, যার কারণে তিনি ঘরে বসে খেলা দেখাই ‘নিরাপদ’ মনে করতেন। পরে তিনি লিভারপুল দলের ভক্ত হয়ে ওঠেন।

প্রথমদিকে তিনি বিজ্ঞান নিয়ে পড়েছিলেন- ভেবেছিলেন দন্ত চিকিৎসক হবেন। পরে একজন শিক্ষকের পরামর্শে তিনি আইন পড়তে যান। ওই শিক্ষক তাকে বলেছিলেন, ‘তুমি সবসময় তর্ক করো।’

১৯৯৪ সালে তিনি একটি আইন সংস্থায় মানবাধিকার আইনজীবী হিসাবে যোগ দেন। ওই বছরই তার স্ত্রী সাদিয়া আহমেদের সঙ্গে তার পরিচয় ও বিবাহ। সাদিয়াও আইন পড়তেন এবং কাকতালীয়ভাবে তিনিও বাসচালকের কন্যা। তাদের দুই কন্য সন্তান আছে - আনিসা আর আম্মারা। সাদিক খান স্থানীয় প্রশাসনে ১২ বছর কাজ করেছেন। ২০০৪ সালে আইনজীবীর কাজ ছেড়ে তিনি পুরো সময়ের জন্য রাজনীতিতে যোগ দেন। ২০০৫ সালে তিনি দক্ষিণ লন্ডনের টুটিং এলাকা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

রাজনীতিতে বিভিন্ন দলে তার সমসাময়িকরা বলেছেন সাদিক খান ‘খুবই বুদ্ধিদীপ্ত’ এবং ‘একগুঁয়ে ব্যক্তি এবং ‘তার যুক্তি খারিজ করে দেয়া প্রায়ই কঠিন’।

২০১০ সালে গার্ডিয়ান পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সাদিক খান বলেছিলেন ‘আমি উদ্ধত কোনো মন্তব্য করতে চাই না- তবে ব্রিটিশ মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে গুছিয়ে যুক্তি দিয়ে বক্তব্য তুলে ধরতে পারে এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম, খুব কম মুসলমানকে বলতে শোনা যায় ‘আমি একইসঙ্গে ব্রিটিশ, মুসলমান এবং লন্ডনবাসী- তা নিয়ে আমি গর্বিত।’

সূত্র: প্রথম আলো