সিরিজ বন্যায় থমকে গেছে সিলেট
বন্যার পর বন্যা। দুই মাসে তিন দফা বন্যা। সিরিজ বন্যা। থেমে গেছে সিলেট। আর চলছে না। মানুষের হাহাকার বাড়ছে। গৃহহারা মানুষের আর্তনাদে ভারী হচ্ছে পরিবেশ। যোগাযোগও বন্ধ। খাবার সংকট তীব্র। আশ্রয়কেন্দ্রই হচ্ছে এখন স্থায়ী নিবাস।
এমন অবস্থা ভাবিয়ে তুলেছে সবাইকে। মানুষের মধ্যে ক্ষোভও বাড়ছে। কবে মুক্তি পাবেন সিলেটবাসী-এ প্রশ্নের উত্তর নেই নীতিনির্ধারক পর্যায়েও। সরকারের পলিসি পর্যায়ে আলোচনা হলেও বাস্তবে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। জনপ্রতিনিধিরাও টায়ার্ড হয়ে পড়েছেন। প্রশাসনের কর্মকর্তারাও বন্যার সঙ্গে লড়াইয়ে ক্লান্ত। পানির সঙ্গে যুদ্ধে কী বা করার আছে। এই অবস্থায় ঝুঁকিতে পড়েছে সিলেট। নগরও বিপর্যস্ত হচ্ছে। তবে আশার কথা হলো এবার আলোচনা শুরু করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে জোর দিচ্ছেন সিলেটের মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। তিনি শুধু নগর নয় এমপিদের নিয়ে গোটা সিলেটকে বন্যার কবল থেকে বাঁচাতে পলিসি লেভেলে আলোচনা শুরু করেছেন। করণীয় নির্ধারণের জন্য সিলেট সফরকালে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনাও করেছেন। মেয়র জানিয়েছেন; অতীতে যা হওয়ার হয়ে গেছে। এভাবে বছর বছর সিলেটকে বন্যায় ডুবতে দেয়া যায় না। এর জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। এ ব্যাপারে পলিসি লেভেলে আলোচনা শুরু করা হয়েছে। সিলেট বাঁচাও, নগর বাঁচাও স্লোগানে কার্যক্রম নেয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তিনি বলেন- প্রধানমন্ত্রী সিলেটের ব্যাপারে খুবই আন্তরিক।
এবারের বন্যায় খোঁজখবর তিনি নিচ্ছেন। আমরা সমস্যা তুলে ধরে সমাধানের পথ খুঁজতে পারলে প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা পাওয়া যাবে। সিলেট জেলা মাত্র দু’মাসের মধ্যে ৩ বার বন্যার কবলে। এ বন্যার অন্যতম কারণ হচ্ছে; ভারতের মেঘালয় ও আসাম রাজ্যের বিস্তীর্ণ এলাকার পাহাড়ি ঢল। বরাক, সারি, ধলাই, পিয়াইন, লোভা নদী হয়ে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এই পানি তীব্র বেগে ছুটে আসে সিলেটে। এতে ডুবে যায় সিলেট। এটি বছর বছর হয়ে থাকে। ঢলের কাছে অসহায় হয়ে পড়েন সবাই। সিলেটের সুরমা অববাহিকার বন্যার পানি এবার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তবে টানা তিন বারের বন্যায় তছনছ হয়ে গেছে সিলেট। এখন কুশিয়ারা অববাহিকার ৬ উপজেলায় তাণ্ডব চালাচ্ছে কুশিয়ারার পানি। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জকিগঞ্জ।
সিলেটের প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা ও জকিগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান লোকমান আহমদ চৌধুরী জানিয়েছেন, তার উপজেলায় কুশিয়ারা নদীর ৮টি স্থান ভেঙে প্রবল বেগে পানি ঢুকেছে। এতে করে ৪ থেকে ৫শ’ ঘরবাড়ি একেবারে বিলীন হয়ে গেছে। ঢলের তোড়ে এসব ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বলে জানান। তিনি বলেন- সুরমা নদীর অংশে ডাইক নির্মাণের প্রকল্প করার কারণে সুরমা অববাহিকার এলাকাগুলোতে ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে। কিন্তু কুশিয়ারা নদী মুক্ত থাকার কারণে তছনছ হয়ে গেছে তীরবর্তী এলাকা।
বালাগঞ্জের উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনহার মিয়া জানিয়েছেন, তিন দফা বন্যার কারণে ‘নাস্তানাবুদ’ বালাগঞ্জ। খোদ সদরে কোমর পরিমাণ পানি। পরপর তিন দফা বন্যার ফলে ঘুরে দাঁড়ানো কষ্টকর হয়ে পড়বে।
তিনি বলেন- শেষ বারের বন্যায় ফেঞ্চুগঞ্জ, বালাগঞ্জ ও ওসমানীনগরের ১১টি স্থানে কুশিয়ারা ডাইক ভেঙে প্রবল বেগে পানি ঢুকেছে। ৪-৫ শ’ বাড়িঘরও তার উপজেলায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। মানুষজন গৃহহীন হয়ে পড়েছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য পরিকল্পিতভাবে ডাইক নির্মাণের পাশাপাশি হাওর, নদী ও খাল নতুন করে খননের উদ্যোগ নেয়া জরুরি বলে জানান তিনি। জেলার পানি বেসিন হচ্ছে ওসমানীনগর। এবার টানা এক মাস ধরে উপজেলার ৮০ ভাগ এলাকা পানির নিচে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ছাড়া সব জায়গায়ই পানি।
উপজেলা চেয়ারম্যান শামীম আহমদ জানিয়েছেন, বন্যা থেকে রক্ষা পেলে স্থায়ী সমাধান জরুরি। এ নিয়ে জেলার সমন্বয় সভায় আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন- নদী খনন ছাড়া এই অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। এজন্য পলিসি লেভেল থেকে এ ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
এদিকে তিন উপজেলাকে বন্যার কবল থেকে রক্ষা করতে একটি প্রকল্প নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সিলেট-৩ আসনের এমপি হাবিবুর রহমান হাবিব। তিনি গতকাল বিকালে জানিয়েছেন, বড় একটি প্রকল্প নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। সেটির সমীক্ষাও শেষ হয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ফেঞ্চুগঞ্জ থেকে ওসমানীনগর পর্যন্ত বেড়িবাঁধ, ব্রিজ নির্মাণ সহ কুশিয়ারা তীর সংরক্ষণ হবে। এই প্রকল্প নিয়ে আমাদের তাগিদ অব্যাহত আছে। তিনি বলেন- সাম্প্রতিক বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। তিনি সার্বিক বিষয়ে অবগত আছেন। স্থায়ী সমাধানের জন্য আমরা সবাই কাজ করছি।
ডাইক নির্মাণের জন্য মানববন্ধন: এবারের বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জকিগঞ্জ উপজেলা। স্থায়ী সমাধান চান এ উপজেলার মানুষ। এ নিয়ে সিলেটে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তারা জানিয়েছেন; প্রতিবছর নদীর ভাঙনে বর্ষা মৌসুমে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে জকিগঞ্জের নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষরা। নদীর পানির প্রবল স্রোতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে বাড়িঘর, ফসলি জমি, কৃষিজমি, কাঁচা-পাকা রাস্তা, গাছপালাসহ নানা স্থাপনা নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। প্রিন্সিপাল মহিউদ্দিন ফারুকের সভাপতিত্বে ও সাংবাদিক মো. হাবিবুর রহমানের পরিচালনায় মানববন্ধনে স্বাগত বক্তব্য রাখেন জকিগঞ্জ উপজেলা প্রেস ক্লাবের সহ-সভাপতি জামাল আহমদ। বন্যা প্রতিরোধ ও দুর্যোগকালীন ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার লক্ষ্যে ৬ দফা লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সিলেটস্থ সচেতন জকিগঞ্জবাসীর সমন্বয়ক রোটারিয়ান মাজহারুল ইসলাম জয়নাল।
মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ইমদাদুর রহমান চৌধুরী, সেইফ জকিগঞ্জের সিনিয়র সহ- সভাপতি মাওলানা মো. মুখলিছুর রহমান, মানবাধিকার কর্মী মারুফ বখতিয়ার চৌধুরী খুররম, প্রিন্সিপাল মাওলানা মঞ্জুরে মাওলা, একাত্তর টিভির সিলেটের ব্যুরো প্রধান হোসাইন আহমদ সুজাদ, শিক্ষানবিশ আইনজীবী জুবায়ের আহমদ, একাডেমাস কোচিং হোমের পরিচালক খালেদ আহমদ, জকিগঞ্জ সোসাইটির সেক্রেটারি আজিজুর রহমান তাপাদার, আমাদের সময়ের সম্পাদক কবি আলিম উদ্দিন আলম প্রমুখ।