সড়ক নিরাপত্তায় ১০-এ ৯!

সড়ক নিরাপত্তায় ১০-এ ৯!

মানুষ হিসেবে প্রত্যেকের অধিকার রয়েছে নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য ও আধুনিক সড়ক ব্যবস্থা প্রাপ্তির আর রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে সেই অধিকার স্বীকার করা এবং নিশ্চিত করা। বাংলাদেশের বিগত দশকের সড়ক ব্যবস্থার পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী কেসস্টাডি করলে যে কেউ এক বাক্যে স্বীকার করতে বাধ্য হবে যে নির্ভরযোগ্য ও আধুনিক সড়ক ব্যবস্থা নিশ্চিতে বর্তমান সরকার যে অগ্রগতি অর্জন করেছে তা পূর্বের অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় ঈর্ষণীয়।

দুই একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। উত্তরা থেকে মতিঝিল এসে মাত্র ৪০ মিনিটে পৌঁছে যাওয়া ঢাকা শহরের মানুষের কাছে স্বপ্নের মতোই ছিল, কিন্তু মেট্রোরেলের কারণে সেই স্বপ্ন এখন সত্যি। ঢাকা থেকে প্রমত্তা পদ্মা পার হয়ে বরিশাল মাত্র ৩ থেকে ৪ ঘণ্টায় পৌঁছানো ছিল অবাস্তব চিন্তা, আর পদ্মা সেতুর কারণে আজ তাও বাস্তব।

আস্তে আস্তে আরও অনেক সড়ক আধুনিকায়ন প্রকল্প সরকার হাতে নিচ্ছে, অনেকগুলো আংশিক থেকে পূর্ণতা পাওয়ার অপেক্ষায়। আমরা বলছি না যে, এইসব আধুনিকায়ন রাতারাতি সব সমস্যা পাল্টে দেবে কিন্তু সরকারের যে ভিশন ও ইমপ্লিমেন্টশন পলিসি তা অবশ্যই আমাদের আশাবাদী করে।

একইসাথে এটাও সত্য যে, মানুষের হাতে তৈরি, মানুষের উপকারের জন্য যে সড়ক তা মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনার মাধ্যমে। আমরা যখন প্রত্যেক বছর শেষে বিভিন্ন উৎস থেকে সড়ক দুর্ঘটনার বাৎসরিক হতাহতের সংখ্যা পেয়ে থাকি তখন তা আমাদের আশাবাদী করে না বরং এই ঝুঁকি কমানোর জন্য কার্যকর টেকসই ব্যবস্থা দৃশ্যমান না হওয়া আমাদের ভীত করে।

বর্তমান সরকার একটি ধারাবাহিকতার মধ্যে আছে যা আমাদের উন্নয়ন নির্বিঘ্ন রাখতে ভূমিকা রাখছে তাই এই সফলতা ধরে রাখতে প্রয়োজন সড়ক নিরাপত্তার জন্য টেকসই কৌশল ও কার্যক্রম গ্রহণ। আগামী ৫ বছরে দেশের মানুষকে একটি নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা উপহার দিতে ১০টি বিষয় নিয়ে নতুন গঠিত সরকার এখনই কাজ শুরু করতে পারে।

প্রথমেই যে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে তা হলো সড়ক নিরাপত্তায় বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়। একটি সংস্থা সড়ক নির্মাণ করছে, আরেক সংস্থা সড়কে যানবাহনের অনুমতি দিচ্ছে, অন্য আরেক সংস্থা ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা করছে আবার অন্য আরেক সংস্থা সড়কের পাশে দোকান, বসতির অনুমতি দিচ্ছে, ইত্যাদি দীর্ঘদিন ধরে চলমান।

এছাড়া এসব সংস্থা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকায় একজন জানতে পারছে না অন্যজন কী পরিকল্পনা করছে? এই সমন্নয়হীনতা দূর করতে হবে। সড়ক নিরাপত্তায় পরিকল্পনা, ব্যবস্থাপনা ও বাস্তবায়নের সব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সব স্টেকহোল্ডারদের সম্পৃক্ত করতে হবে ও মতামত নিতে হবে।

আর এটা করার জন্য সবাইকে এক মন্ত্রণালয়ের অধীনে আসতে হবে ব্যাপারটি তা নয়, বরং ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অরডিনেশন অথরিটি (ডিটিসিএ)-কে কার্যকর করা, মেট্রো রোড সেফটি কমিটি, জেলা রোড সেফটি কমিটি ও উপজেলা রোড সেফটি কমিটিগুলো সচল করে এই সমন্বয় করা সম্ভব।

...একইসাথে এটাও সত্য যে, মানুষের হাতে তৈরি, মানুষের উপকারের জন্য যে সড়ক তা মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনার মাধ্যমে।

দ্বিতীয়ত যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি শুরু করতে হবে তা হলো সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য ব্যবস্থাপনা ও স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে তা শেয়ার করা। তথ্য ব্যবস্থাপনা বলতে বোঝানো হচ্ছে জাতীয় একটি সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য সংগ্রহ সিস্টেম থাকবে যা পুলিশ কর্তৃক পরিচালিত হবে এবং অন্যসব সংস্থা যেমন মন্ত্রণালয়, সিটি কর্পোরেশন, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সড়ক নির্মাণ ও নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলো সেই সিস্টেমের সাথে সংযুক্ত থাকবে যাতে করে গবেষণা সংক্রান্ত, সড়ক নিরাপদকরণ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত ইত্যাদি একটি নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে গ্রহণ করা সম্ভব হয়।

এজন্য পুলিশকে প্রয়োজনীয় বাজেট, জনবল লজিস্টিকস ও প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে এবং এই সংশ্লিষ্টদের বদলি যত কম হয় ততই ভালো যাতে করে এক্সপারটাইস গ্রো করতে পারে। এই কাজের সফলতার জন্য জনগণের মাঝে একটি দুর্ঘটনা হলে তা এড়িয়ে না গিয়ে রিপোর্ট করার বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করাও জরুরি।

তথ্য সংগ্রহ ও শেয়ারিং নিশ্চিত হওয়ার পর তৃতীয় যে বিষয়টি জরুরি তা হলো প্রতি বছর তথ্য-উপাত্তের বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা করে রিপোর্ট প্রকাশ ও প্রাপ্ত ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে প্রকৌশলগত, আইনগত ও সচেতনতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এর ফলে কম খরচে কার্যকর ট্রিটমেন্ট প্রদান করা সম্ভব হবে।

চতুর্থত যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, সড়ক দুর্ঘটনা যেহেতু একটি নিয়মিত ও জনগণের জানমালের সাথে সম্পর্কিত বিষয়, তাই এই সংক্রান্ত আইনকে সড়ক পরিবহন আইনের একটি অংশ হিসেবে না রেখে আলাদা করে সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা যেখানে সড়ক নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ, যানবাহন নিয়ন্ত্রণ, গতি নিয়ন্ত্রণ, ব্যবহারকারীদের আচরণ নিয়ন্ত্রণের বিষয়গুলো আরও বিশদভাবে অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

পঞ্চমত যে বিষয়টি নিশ্চিত করা প্রয়োজন তা হলো আইনের সঠিক ও সমান প্রয়োগ। সড়কের আইন সবার জন্য সমানভাবে কার্যকর করার ব্যাপারে সরকারকে একটি সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমরা বিভিন্ন সময়ে দেখেছি যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে টোল প্রদান বা টিকেট কেটে সড়ক ব্যবহার করছেন যা সবার জন্য দৃষ্টান্ত। তা থেকে একটি বার্তা সবার কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা যে, কেউ নিয়মের বাইরে নয়।

আমাদের পুলিশবাহিনী অত্যন্ত দক্ষতার সাথেই কাজ করছে। এখন তাদের যদি আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোনো বাধা না দেওয়া হয় এবং একই সাথে হয়রানি করছে কি না তা মনিটর করা হয় তাহলে আইন সবার জন্য বাস্তবায়ন করা সম্ভব এবং এতে করে সড়ক অনেক বেশি সুশৃঙ্খল ও নিরাপদ হবে।

....যে বিষয়টি আমাদের প্রয়োজন তা হলো, যানবাহনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এর মানে হলো একই সড়কে বিভিন্ন গতির, বিভিন্ন অবৈজ্ঞানিক ডিজাইনের যান ও নিম্নমানের সেফটি রেটিং প্রাপ্ত গাড়ি চলাচল বন্ধ করতে হবে।

ষষ্ঠত আমাদের নজর দিতে হবে চালক প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্স প্রদানে আধুনিক পরীক্ষা পদ্ধতি প্রচলনের দিকে। ড্রাইভিং ইন্সটিটিউট থেকে নির্দিষ্ট ঘণ্টার থিউরি ও প্র্যাকটিক্যাল অভিজ্ঞতা গ্রহণ পূর্বক সেই সনদ জমা দিয়ে যাতে একজন বিআরটিএতে লাইসেন্স-এর পরীক্ষা দিতে বসে তা নিশ্চিত করতে হবে।

একইসাথে পরীক্ষা পদ্ধতি আরও মানসম্মত করা দরকার। এখনো পর্যন্ত বিআরটিএ-এর প্রায় সব কেন্দ্রে পরীক্ষা গ্রহণ, বিশেষ করে প্র্যাকটিক্যাল নেওয়ার মতো জায়গা নেই। এজন্য বিআরটিএ কে প্রয়োজনীয় জায়গা, লজিস্টিকস, জনবল ও বাজেট প্রদান করতে হবে, পাশাপাশি স্বচ্ছতা নিশ্চিতে কঠোর হতে হবে।

সপ্তম যে বিষয়টি আমাদের প্রয়োজন তা হলো, যানবাহনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এর মানে হলো একই সড়কে বিভিন্ন গতির, বিভিন্ন অবৈজ্ঞানিক ডিজাইনের যান ও নিম্নমানের সেফটি রেটিং প্রাপ্ত গাড়ি চলাচল বন্ধ করতে হবে।

এরপরই অষ্টম যে বিষয়টি আমাদের গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন তা হলো সড়ক নিরাপত্তা শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কার্যক্রম গ্রহণ। স্কুল পর্যায়ে সহ-শিক্ষা কার্যক্রম হিসেবে আমরা সড়কের নিরাপদ চলাচলের নিয়ম যেমন প্রদর্শন এবং সব পর্যায়ে সচেতনতার জন্য প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে প্রচার, সেমিনার, টার্মিনাল ভিত্তিক আলোচনা ও প্রশিক্ষণ ইত্যাদি নিয়মিত করতে পারি। এক্ষেত্রে বাজেট যেমন প্রয়োজন তেমনি মিডিয়াগুলো যদি অন্তত ১ মিনিট জনস্বার্থে ব্যয় করে তাও আমাদের জন্য অনেক অর্থবহ হবে।

সর্বশেষ নবম যে বিষয়টি আমাদের নিশ্চিত করতে হবে তা হলো দুর্ঘটনা পরবর্তী চিকিৎসা ব্যবস্থা। একজন আহত ব্যক্তিকে দ্রুত উদ্ধার ও চিকিৎসা কেন্দ্রে পৌঁছানোর জন্য যে গোল্ডেন আওয়ারের গাইডলাইন আছে তা নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত লজিস্টিকস, জনবল, তথ্য প্রদান সহজকরণ, ট্রমা সেন্টার চালু ও সব হাসপাতাল ও ক্লিনিককে এই ব্যাপারে সমন্বয় করা জরুরি। কোনো হাসপাতাল বা ক্লিনিক যেন আহত ব্যক্তিকে দ্রুত প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদান করে সেই বিষয়ে একদিকে যেমন কঠোর হতে হবে অন্যদিকে এই সংক্রান্ত ব্যয় বহনে চিকিৎসা কেন্দ্রগুলো ট্রাস্টি বোর্ডের সাথে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।

উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলোর সবগুলোয় যে আমরা পিছিয়ে আছি তেমনটি কিন্তু না। এই যেমন ২০২৩ সালে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো, গুরুত্বপূর্ণ একটি শহর চট্টগ্রামের সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের সহযোগিতা ও দিক নির্দেশনায়, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে একটি বিজ্ঞানভিত্তিক রিপোর্ট প্রকাশিত হয় যার ফলাফলের উপর ভিত্তি করে বেশকিছু সড়ক নিরাপত্তা কার্যক্রম গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

এছাড়া চলতি বছরে প্রথমবারের মতো বিআরটিএ বিগত বছরের সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য-উপাত্ত শেয়ার করল যা আমাদের তথ্য বিভ্রাট কমাতে সাহায্য করবে। এছাড়া বিভিন্ন পর্যায়ে আরও কিছু কাজ হচ্ছে আর এভাবেই কিন্তু ভালো পদক্ষেপগুলো শুরু হয়, প্রয়োজন শুধু চলমান রাখতে সাহায্য করা।

লেখার শুরুতে দশটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করলেও নয়টি বিষয় পর্যন্ত বলা হলো কারণ আর একটি বিষয় হলো নিয়তি যা সৃষ্টিকর্তার হাতেই থাকল। আমরা যদি প্রতিটি বিষয়ের জন্য ১ পয়েন্ট করে ধরি তাহলে নয়টি বিষয় যা আমাদের হাতে আছে তা বাস্তবায়ন করেই কিন্তু সহজেই ৯ পয়েন্ট পেতেই পারি। আর সড়ক নিরাপত্তার এই পরীক্ষায় সরকার ১০ এ ৯ পেলেই অনেকগুলো মানুষের জীবন বেঁচে যাবে, অনেকগুলো পরিবার বেঁচে যাবে।

কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ ।। সহকারী অধ্যাপক (অন-লিভ), এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট, বুয়েট; সার্ভিলেন্স কো-অর্ডিনেটর, বিআইজিআরএস