নৌকার পক্ষে ভোট চাওয়া সেই হারুন এখন গোয়াইনঘাট থানার ওসি
২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি-জামায়াত নেতৃবৃন্দকে থানায় ধরে নিয়ে অমানবিক নির্যাতন, মুক্তিপণ আদায় সহ নানা বিতর্কিত কর্মকান্ডে সমালোচিত ছিলেন সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের জালালাবাদ থানার তৎকালীন ওসি শাহ হারুন অর রশীদ। গত ১৭ আগস্ট তাকে গোয়াইনঘাট থানায় ওসি হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে। এ নিয়ে তীব্র সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে।
অন্যদিকে, ওসি শাহ হারুনের বিরুদ্ধে বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চাকুরিবিধি লঙ্ঘন করে আওয়ামী লীগের এক প্রার্থীর প্রচারণা অনুষ্ঠানে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলেন। এমন ছবিও পাওয়া গেছে। বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নির্যাতিত নেতাকর্মীরাও এই ওসির শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। তারা ওসি হারুনের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরেরও প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
যেভাবে উত্থান ওসি শাহ হারুনের:
ওসি শাহ হারুন অর রশীদের বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার শক্তিয়ারখলা গ্রামে। বাবার মৃত শাহ মো. আব্দুছ ছাত্তার। পড়াশোনা করেছেন সিলেট এমসি কলেজে। পুলিশে যোগদানের পর থেকে নানা কারণে হয়েছেন আলোচিত-সমালোচিত। বিশেষ করে উপপরিদর্শক থাকাকালে সিলেটের বিয়ানীবাজার থানা ও আজমিরীগঞ্জ থানায় নারী ঘটিত বিষয় নিয়ে পড়েছিলেন শাস্তির মুখে। ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের দক্ষিণ সুরমা ও জালালাবাদ থানায়। শিল্পাঞ্চল পুলিশ ঘুরে পুনরায় ফেরেন সিলেটে। কোর্ট ইন্সপেক্টর থেকে সর্বশেষ পদায়ন হয়েছে সিলেটের গোয়াইনঘাট থানার ওসি হিসেবে। দেশে ছাত্র-জনতার জয়ের পর স্বঘোষিত আওয়ামী লীগ নেতা শাহ হারুন অর রশীদের ওসি হিসেবে পদায়ন নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক।
যেভাবে হয়ে উঠেছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা:
২০১৭ সালে দক্ষিণ সুরমা থানায় ওসির দায়িত্বকালে কোন কারণে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করেন জনতা। তখন হঠাৎ জনপ্রতিনিধির মতো টেবিলে উঠে জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয়া শুরু করেন ওসি হারুন। একপর্যায়ে জনতাকে হুমকি দিয়ে বলেন, ‘আপনারা হয়তো জানেন না আমি নিজেও একসময় এমসি ছাত্রলীগের নেতা ছিলাম। আমার নেতা মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ। উনারাই আমাকে সিলেটে নিয়ে এসেছেন। সড়ক অবরোধ তুলে না নিলে দেখে ছাড়বো বলে হুমকি দিয়েছিলেন। ওই সময়ে গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছিলেন তিনি। এরপর আর সমালোচনা পিছন ছাড়েনি তার। ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগ নেতাদের বিশ্বস্ত হয়ে উঠেন।’
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও জালালাবাদ থানা:
আওয়ামী লীগের বিশ্বস্ত হওয়ায় ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগ মুহূর্তে ওসি শাহ হারুনকে নিয়ে আসা হয় এসএমপির জালালাবাদ থানায়। তখন জালালাবাদ থানা এলাকায় বিএনপি জামায়াতের কাছে এক মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হন। সাধারণ ভিকটিমের সাথেও বিএনপি জামায়াতের কেউ থানা এলাকায় প্রবেশ করতে পারতেন না। সদ্য ঘোষিত সিলেট জেলা যুবদলের সহ কৃষি বিষয়ক সম্পাদক সামাদ আহমদ সাজু বলেন, নিরীহ দুই আত্মীয়কে ধরে জালালাবাদ থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। খবর পেয়ে তিনি স্বজনদের সাথে ছুটে গিয়েছিলেন। ছাত্রদলকর্মী পরিচয় পেয়ে তাকে জোর করে লকাপে ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালায়। একপর্যায়ে পায়ে হাতে ধরে কোন রকমে মুক্ত হন। সামাদ বলেন, ওসি হারুন ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন কোন বিএনপি- জামায়াতের কর্মী যেন থানায় কারো সঙ্গে না আসে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সক্রিয় ছিলেন হারুন:
সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট অঞ্চলের কোনো থানায় দায়িত্বে না থাকলেও বসে থাকেননি ওসি শাহ হারুন। নির্বাচনের আগ মুহূর্তে ছুটে এসেছিলেন সিলেটে। যেখানে সুনামগঞ্জ-৪ আসনের আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ড. মোহাম্মদ সাদিকের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়েছিলেন। সিলেট নগরীর নির্ভানা ইন হোটেলে ‘ড. মোহাম্মদ সাদিকের সাথে সুনামগঞ্জ সদরের উত্তর সুরমাবাসী ও বিশ্বম্ভরপুর সমিতির মতবিনিময় সভা’য় অংশ নেন। ব্যানারে লেখা ছিল আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ড. সাদিককে নৌকা মার্কায় ভোট দিন। দেখা গেছে, ওই সভায় ওসি শাহ হারুন অর রশীদ মঞ্চে আসীন রয়েছেন। তিনি তখন ঢাকার শিল্পাঞ্চল পুলিশে কর্মরত ছিলেন।
ভুক্তভোগীদের মুখে নির্যাতনের যত কাহিনী:
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের থানায় ধরে নির্যাতন করতেন ওসি শাহ হারুন। একাধিক ভুক্তভোগীর সাথে কথা বলে নির্যাতনের নানা চিত্র উঠে এসেছে।
তৎকালীন টুকেরবাজার ইউনিয়নের মেম্বার হাফিজুর রহমান বলেন, বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত তিনি। একদিন সকালে ওসি হারুন তাকে ফোন দিয়ে বলেন, থানায় একটি পার্টি আছে, তোমাকে খাসি দিতে হবে। মামলার ভয়ে খাসির জন্য ২০ হাজার টাকা পাঠিয়েছিলেন হাফিজ। ওই টাকায় মন ভরেনি ওসি হারুনের। হাফিজ মেম্বার জানান, ওই দিনই সন্ধ্যায় তাকে পুলিশ পাঠিয়ে থানায় নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করেন। পরে রাতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সহায়তায় ১ লাখ টাকা দিয়ে তিনি থানা থেকে মুক্তি পান।
হাফিজ আরো জানান, দুইদিন পর ধানের শীষের প্রার্থী খন্দকার মুক্তাদির যেন তার নোয়া খুররমখলা এলাকায় গণসংযোগ না করেন সেই ব্যবস্থা করতে। কিন্তু গণসংযোগ পূর্ব নির্ধারিত হওয়ায় যথারীতি গণসংযোগ হয়। ওই দিন রাতেই দোকান থেকে তার ছোট ভাইকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। এরপর একাধিক মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে চালান দেয়।
হাফিজ মেম্বারের বড় ভাই হামিদুর রহমান জানান, তিনি যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফিরেন। তাকেও একটি মামলায় আসামি করেন ওসি। ওই মামলায় এখনো তিনি নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছেন।
জালালাবাদ থানার তালুকদারপাড়া এলাকার বাসিন্দা মাছুম তালুকদার বিএনপির সক্রিয় কর্মী ছিলেন। বর্তমানে তিনি কানাডা প্রবাসী। মাছুম তালুকদার নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে কাঁদছিলেন। তিনি জানান, নির্বাচনের মাসখানেক আগে পুলিশ তাকে থানায় ধরে নিয়ে যায়। এরপর ৩ লাখ টাকা উৎকোচ দাবি করেন। না দিলে থানায় বিএনপি- জামায়াতের যত মামলা আছে, সব মামলায় ঢুকিয়ে দেয়ার হুমকি দেন ওসি। মাছুম জানান, তার কাছে টাকা নেই দাবি করলে ওসি উল্টো বলেন, ‘তুই জায়গা বিক্রি করে ৫০ লাখ পেয়েছিস, কে বলেছে তোর কাছে টাকা নেই।’ এরপর চলতে থাকে নির্যাতন। মাছুম বলেন, একপর্যায়ে লাথি মারেন ওসি। এতে জায়গায় প্রশ্রাব করে কাপড় ভিজিয়ে দেন। ভোর বেলা বাসা থেকে কাপড় এনে পরিবর্তন করা হয়।
তখন ওই থানায় কর্মরত ছিলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ সদস্য জানান, মাছুমের উপর নির্যাতন দেখে চোখের পানি চলে এসেছিলো। নির্যাতন করতে মানা করায় স্যার উল্টো আমার চাকুরি খাওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। অন্যদিকে নির্যাতিত মাছুম তালুকদার বলেন, তার স্বজনরা ওসি হারুনের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
জালালাবাদ থানার ঘোপাল গ্রামের বাসিন্দা মতিউর রহমান জানান, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তিন দিন আগে জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে প্রতিবেশীরা তার উপর হামলা চালায়। তিনি এই অভিযোগ নিয়ে জালালাবাদ থানায় গিয়েছিলেন। এজাহারে তার অভিযুক্ত ছিলেন ৬ জন। কিন্তু এজাহার দিয়ে বাড়ি ফেরার পরদিন জানতে পারেন তার মামলায় ১৪০ জনকে আসামী করা হয়েছে। যাদের মধ্যে নিজের আত্মীয় স্বজনও রয়েছেন। এরপর নির্বাচনের পর মামলা প্রত্যাহারের চেষ্টা করলে ওসি হারুন উল্টো মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার হুমকি দেন। মতিউর রহমান বলেন, সেই মামলাটি এখনো চলছে।
অন্যদিকে ওসি হারুন জালালাবাদ থানায় দায়িত্ব পালনকালে এলাকায় মনফর বাহিনীর উত্থান হয়েছিলো বলে অভিযোগ রয়েছে।
যেভাবে গোয়াইনঘাট থানার ওসি হারুন:
আওয়ামী লীগের আমলে সিলেটের পুলিশ প্রশাসনে কট্টর আওয়ামীপন্থি পুলিশ অফিসার হিসেবে পরিচিত শাহ হারুন ছাত্র-জনতার বিজয়ের পর ভালো থানায় দায়িত্ব পেতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। বেছে নেন এমসি কলেজে পড়াকালীন সহপাঠীদের। সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে একটি প্রধান রাজনৈতিক দলের শীর্ষ পদে রয়েছেন-এমন সহপাঠীদের ব্যবহার করে নিজেকে সাবেক ছাত্রদলকর্মী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন। এক্ষেত্রে সফলও হন। চোরাচালানের নিরাপদ রুট হিসেবে পরিচিত সীমান্তবর্তী গোয়াইনঘাট এলাকায় গত ১৭ আগস্ট ওসি হিসেবে যোগদান করেন। ছাত্র-জনতার বিজয়ের পর ওসি হারুনের এমন পুরস্কৃত পদায়নে বিস্মিত হয়েছেন নির্যাতিতরা।
ওসি হারুনের বক্তব্য:
এ ব্যাপারে গোয়াইনঘাট থানার ওসি শাহ হারুন অর রশীদ স্বীকার করেন তিনি আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী ড. মোহাম্মদ সাদিকের মতবিনিময় সভায় অংশ নিয়েছিলেন। যে সংগঠনের ব্যানারে সভা হয়েছে, সেই সংগঠনের সভাপতি ছিলেন তিনি। সংগত কারণে তাকে থাকতে হয়েছে। তিনি বলেন, তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জোর করে তাকে জালালাবাদ থানায় নিয়ে এসেছিলেন। তিনি বিএনপি-জামায়াতের কর্মীদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের কথা অস্বীকার করেন।
পুলিশ সুপারের বক্তব্য:
এ ব্যাপারে সিলেটের পুলিশ সুপার বলেন, অতীতে সাধারণ মানুষের উপর হয়রানি ও নির্যাতন করেছেন এমন পুলিশ অফিসারদের ব্যাপারে প্রসিডিউর চলছে। শিগগিরই এর ফল পাবেন। এর বাইরে তিনি আর কোন মন্তব্য করেননি। সুত্র: সিলেটের ডাক