শাবলের আঘাতে কঙ্কাল টিলা

শাবল দিয়ে আঘাত করে টিলার মাটি সরাচ্ছেন শ্রমিকরা। সেই মাটি গড়িয়ে পড়ছে কয়েক ফুট নিচে। বেরিয়ে আসছে ছোট-বড় পাথর। যেন কঙ্কাল থেকে বেরিয়ে আসা হাড়। টিলার পাশে বিভিন্ন গর্তের একাধিক স্থানে ট্রাকে পাথর লোড করছে আরেক দল শ্রমিক। পরে তা চলে যাবে সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। এই পাথর উত্তোলনের ফলে টিলার চারদিকে অনেকটা পুকুরের মতো হয়ে গেছে। যার কারণে চলাচল করাও কঠিন। গত শনিবার এ দৃশ্য দেখা গেছে সিলেটের সীমান্তবর্তী কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম ইসলামপুর ইউনিয়নের শারফিন টিলা ও সেখানকার পাথর কোয়ারিতে।
শুধু শারফিন টিলাই নয়; পাথর ও বালু লুট হচ্ছে একই উপজেলার ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি, পাশের সাদা পাথর পর্যটন কেন্দ্র ও রেলওয়ের বাংকার এলাকা থেকে। অভিযোগ রয়েছে, সরকার পতনের পর কম হলেও ৩০-৪০ কোটি টাকার পাথর লুট করা হয়েছে এখান থেকে। অথচ ভোলাগঞ্জ এলাকায় চারটি বিজিবি ক্যাম্প ও পোস্ট রয়েছে।
শারফিন টিলা ধ্বংসের অভিযোগে ২০০৯ সালের ১১ নভেম্বর পরিবেশ অধিদপ্তরের ক্ষতি নির্ধারণী টিম তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে ১৩৭ দশমিক ৫০ একরের এ টিলাকে ‘মরা কঙ্কাল’ হিসেবে উল্লেখ করেছিল। পাশাপাশি পাথর উত্তোলন ও পরিবেশ ধ্বংসে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান বশির অ্যান্ড কোম্পানির কাছ থেকে ২৫১ কোটি ৫০ লাখ ৯০ হাজার টাকা আদায়ের প্রস্তাব করে। ২০০৪ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত থেমে থেমে ধ্বংসযজ্ঞ চলে শারফিন টিলা ও সেখানকার পাথর কোয়ারিতে। ফলে কোয়ারি ও টিলা পরিণত হয়ে ওঠে বিরান ভূমিতে। সরকার পতনের পর সেই মরা কঙ্কাল শারফিন টিলায় চলছে শাবলের তাণ্ডব। এতে ঘটেছে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়। অস্তিত্ব সংকটে থাকা টিলার অবশিষ্ট অংশ ও মাজার বিলীন হওয়ার পথে। ইতোমধ্যে সেখানকার কবর ও খেলার মাঠের অধিকাংশ বিলীন হয়ে গেছে। পাথরখেকোদের আগ্রাসে বিলীন ও বন্ধ হয়ে গেছে মাজারে যাতায়াতের রাস্তা।
শারফিন টিলায় এখন যাদের রাজত্ব
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চিকাডহর মৌজার বিশাল একটি টিলায় কয়েকশ বছর আগে আস্তানা গেড়েছিলেন শাহ আরেফিন (শারফিন) নামে এক ওলি। সেই টিলাটি পরবর্তী সময়ে শারফিন টিলা হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। ৩০ বছর আগে টিলার অংশসহ আশপাশের ১৩৬ একর জায়গাকে শারফিন টিলা পাথর কোয়ারি হিসেবে গেজেটভুক্ত করে সরকার। পরে মাজারের জন্য প্রায় ৮ একর জায়গা ওয়াক্ফ এস্টেটের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০ বছর ধরে পাথর উত্তোলন করার ফলে কোয়ারি এবং টিলার বিভিন্ন অংশ ধ্বংস করা হয়। অতীতে একাধিক সিন্ডিকেটের ধ্বংসের পর ২০২০ সালে শারফিনসহ কয়েকটি কোয়ারিতে পাথর উত্তোলন বন্ধ করে সরকার। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর নতুন করে এ টিলা কেটে পাথর উত্তোলন শুরু করে স্থানীয়রা। যাদের নামে অভিযোগ– স্থানীয় জালিয়ারপাড়ের বাসিন্দা ও মাজারের সাবেক খাদিমের ছেলে মনির মিয়া, ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক সভাপতি ফয়জুর রহমান, বিএনপিকর্মী জালিয়ারপাড়ের সেবুল আহমেদ ও একই দলের আফছর উদ্দিন, একই গ্রামের ইব্রাহিম মিয়া, জামায়াতের ইয়াকুব আলী, জালিয়ারপাড়ের কালা মিয়া, ফারুক মিয়া, রফিক মিয়া, গৌছ মিয়া, চিকাডহর গ্রামের শাহীন মিয়া, আব্দুর রশিদ, আদই মিয়া, আইয়ুব আলী ও আব্দুল কুদ্দুছ, বাহাদুরপুরের ওমর গাজী, শাহা মিয়া, বাবুলনগরের সোনা মিয়া, জালিয়ারপাড়ের আব্দুর রহিমসহ কয়েকজন। তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে এখন টিলা কেটে পাথর লুট হচ্ছে। প্রতিদিন ২০-৪০ ট্রাক পাথর সেখান থেকে বিক্রি করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ৪-৫ কোটি টাকার পাথর বিক্রি করা হয়েছে।
স্থানীয় পশ্চিম ইসলাম ইউপি চেয়ারম্যান জিয়াদ আলী পাথর উত্তোলনের কথা স্বীকার করলেও বক্তব্য দিতে চাননি। যুবলীগ নেতা ফয়জুর নিজের সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করে বলেন, যে যার মতো পাথর উত্তোলন করছে। শ্রমিকরা বাঁচার জন্য এসব করছে।
অভিযুক্ত মনির মিয়া বলেন, আগের যারা মালিকানা দাবি করে পাথর উত্তোলন করেছিল, তারা এখন কেউ জড়িত নয়।
শারফিন ওয়াক্ফ এস্টেটের মোতাওয়ালি আনোয়ার হোসেন আনাই বলেন, আমরা বাধা দিয়েও পারছি না। অতীতে জনপ্রতিনিধি নিয়েও প্রতিবাদ করেছি। টিলার ওপর খেলার মাঠ, গোরস্তান, মক্তব ও মসজিদ রয়েছে। ইতোমধ্যে অর্ধেক গোরস্তান ও মাঠ বিলীন। মক্তবও বন্ধ। মাজার রক্ষা করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
ভোলাগঞ্জের রকম ফের
দেশের প্রধান কোয়ারি ভোলাগঞ্জ। সঙ্গে রয়েছে ধলাই নদী বালুমহাল। কোয়ারির পাশে রেলের বাঙ্কার এলাকা। এর উত্তরে সীমান্তঘেঁষা সাদা পাথর পর্যটন কেন্দ্র। সরকার পতনের পর দুই দিনে কম হলেও ১৫ কোটি টাকার সাদা পাথর লুট হয়। সোমবার পর্যন্ত আরও ১০ কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে। বালু-পাথর লুট অব্যাহত থাকায় গত কয়েক দিন ধরে নড়েচড়ে বসে উপজেলা প্রশাসন। গত রোববার মধ্যরাতে টাস্কফোর্স অভিযানে ১৩৬টি কাঠের নৌকা ও ৫শ ফুট পাথর জব্দ করা হয়। সরকার পতনের পর রেলওয়ে পুলিশ ও আনসার সদস্যরা সাদা পাথর ও বাঙ্কার এলাকা থেকে চলে গেলে অরক্ষিত হয়ে পড়ে সেই এলাকা। তবে চারটি বিজিবি ক্যাম্প ও পোস্ট থাকার পরও প্রতিদিন ৬-৭ লাখ টাকার পাথর লুট করা হয়। অভিযোগ ওঠে, প্রশাসনের দুর্বলতার কারণে বিজিবিকে ম্যানেজ করেই তা লুট করা হচ্ছে।
শনিবার দেখা গেছে, ভোলাগঞ্জ রেলের বাঙ্কার এলাকার তিনটি স্থানে কয়েকজন শ্রমিক পাথর উত্তোলন করছে। সরকার পরিবর্তনের পর বারকি শ্রমিকদের একাধিক সিন্ডিকেট, ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতাকর্মী তা নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। এদের মধ্যে রয়েছেন ব্যবসায়ী শৈবাল শাহরিয়ার সাজন, আওয়ামী লীগের লাল মিয়া, তোফাজ্জুল হোসেন রাজু, ট্রাক পিকআপ কাভার্ডভ্যান শ্রমিক ইউনিয়ন সভাপতি কবির হোসেন ও সেক্রেটারি মাহফুজ মিয়া, যুবদলের বাহার আহমদ রুহেল, আওয়ামী লীগের মতিউর রহমানসহ ১৫-২০ জন। লুট করা এসব বালু-পাথর স্তূপ করে রাখা হয় ধলাই নদীর ফাঁড়ি নদীঘাট, গুচ্ছগ্রাম বাজার নদীঘাট, নতুনবাজার ও কলাবাড়ী এলাকায়। পরে ট্রাক ও পিকআপে বালু-পাথর কলাবাড়ি, পাড়ুয়া ও ধোপাগুল এলাকার ক্রাশার মিলে বিক্রয় করা হয়। ধোপাগুল ক্রাশার মিলে পাথর বিক্রি করেন আব্দুল আহাদ, আব্দুল মতিন, রাজু আহমদ, ইকবাল, জয়নাল আবেদীনসহ কয়েকজন। দলের কোনো নেতাকর্মী জড়িত নয় দাবি করে উপজেলা বিএনপি সভাপতি সাহাব উদ্দিন জানান, লুটের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান।
যা বলেছেন সংশ্লিষ্টরা
সীমান্তের ভোলাগঞ্জ ও শারফিন টিলা থেকে পাথর লুট বিষয়ে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবিদা সুলতানা বলেন, ভোলাগঞ্জে একাধিক অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এটা অব্যাহত থাকবে। শারফিন টিলায়ও অভিযান পরিচালনা করা হবে। প্রশাসন প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় কাজ করছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) সিলেট বিভাগের সমন্বয়ক শাহ সাহেদা আখতার বলেন, শারফিন টিলা আগেই ধ্বংস করা হয়েছে। সরকার পরিবর্তনের পর আবার বিভিন্ন কোয়ারিতে কৌশলে লুটপাট করছে। স্থানীয় প্রশাসনের দুর্বলতার কারণে এসব হচ্ছে। সুত্র্র: সমকাল