সিলেটের বিভিন্ন উপজেলা ও পৌরসভার সেবা ব্যাহত

কর্তারা আত্মগোপনে, নাগরিকদের দুর্ভোগ

কর্তারা আত্মগোপনে, নাগরিকদের দুর্ভোগ

“রাজ্যের দুর্দশায়, দুর্ভোগে প্রজাতন্ত্র”- আসলে এটা আদি যুগের কোনো রাজার রাজ্যের কাহিনী নয়। বর্তমান সময়ে সিলেট সিটি করপোরেশনসহ সিলেটের বেশিরভাগ উপজেলা কিংবা পৌরসভার অবস্থা অনেকাংশে এরকম। ৫ আগস্ট শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের তোপের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ে। ভেঙে পড়ে শাসন ব্যবস্থা। সিলেটের বিভিন্ন উপজেলা ও পৌরসভার মসনদে ছিলেন আওয়ামী লীগ মনোনীত ব্যক্তিরা। কিন্তু সরকার পতনের পরপরই সেই উপজেলা ও পৌরসভাগুলোর দায়িত্বে থাকা চেয়ারম্যান এবং মেয়ররা গা ঢাকা দেন। উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌরসভার মেয়ররা গা ঢাকা দেওয়ার ফলে অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে গোটা সিলেট বিভাগ। আর এতে করে দেখা দেয় চরম বিপত্তি। দুর্ভোগে পড়েন উপজেলা ও পৌর এলাকার জনসাধারণ। কর্মক্ষেত্রে নেমে আসে স্থবিরতা। ব্যাহত হয় নাগরিক সেবা।

সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে সিলেটের বিভিন্ন সাবেক এমপি-মন্ত্রীদেরও দেখা মিলছে না। তাদের অনেকে দেশ ত্যাগ করেছেন আবার অনেকে দেশ ত্যাগের সুযোগ খোঁজছেন বলেও জানা যায়। সিলেটে কিছুদিন আগেও সাবেক মন্ত্রী ও এমপিসহ আওয়ামী লীগের বাঘা বাঘা নেতাকর্মীরা ছিলেন সক্রিয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরুর দিকে আওয়ামী লীগ নেতারা বিভিন্ন বিবৃতি দিতে থাকেন। কিন্তু শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে দেশ ত্যাগের পর তাদের কারও দেখা মিলছে না। সিলেটের ১৯ এমপিসহ আওয়ামী লীগের বাঘা বাঘা নেতারাও চলে গেছেন আত্মগোপনে।

এদিকে, সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র ও বিভিন্ন পৌর মেয়রসহ অনেক জনপ্রতিনিধিরও হদিস মিলছে না। রাজনৈতিক প্রভাবশালীরাও দেশ ছাড়ছেন বলে জানা গেছে। অনেকে ভয়ে দেশের অভ্যন্তরে আত্মগোপনে চলে যাচ্ছেন। শুধু মন্ত্রী-এমপি বা প্রভাবশালীই নয়, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন অঙ্গসহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতারাও ভয়ে আত্মগোপনে আছেন। এই তালিকায় আছেন আওয়ামী লীগের দলীয় প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরাও। ফোনে কল দিলে তাদের কাউকেই পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ত্যাগ করার খবর পেয়ে সিলেটের আওয়ামী লীগের এমপিসহ অনেক নেতাকর্মীর বাসায় হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে।

এদিন জনতার আনন্দ মিছিল শেষে মোটরসাইকেলে মহড়া দিয়ে একদল যুবক নগরীর শাপলাবাগ এলাকায় সাবেক প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী এবং সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরীর বাসভবন ভাঙচুর করার পর আগুন দেয়। পার্শ্ববর্তী পূর্ব শাপলাবাগ এলাকায় সিলেট সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আজাদুর রহমান আজাদ, গোপালটিলা এলাকায় অবস্থিত সুনামগঞ্জ-১ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য রনজিত সরকার, সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাসুক উদ্দিন আহমদ, সহ-সভাপতি আসাদ উদ্দিন ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন খানের বাসায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়।

যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর বাসায় একদল দুর্বৃত্ত হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। আকস্মিক হামলা চালায় সিলেট জেলা জাসদের সভাপতি লোকমান আহমদ ও সিসিকের ৫নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর রেজওয়ান আহমদের বাসায়ও।

এছাড়াও আওয়ামী লীগ সমর্থিত অনেক ব্যবসায়ীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) কার্যনির্বাহী সদস্য ও সিলেট জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মাহি উদ্দিন আহমদ সেলিমের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মাহায় হামলা ও লুটপাট করা হয়।

অপরদিকে উপজেলাগুলোতেও দুর্বৃত্তরা হামলা করে বিভিন্ন জনপ্রতিনিধি ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাসাবাড়িতে। গোয়াইনঘাটে কয়েক শতাধিক দুর্বৃত্তরা হামলা চালায় সিলেট জেলা পরিষদের সদস্য সুবাস দাসের বাড়িতে। এ সময় সুবাস দাসের বাড়ি ভাঙচুর করে তার বাড়ির সবকিছু লুট করে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই হামলায় তার স্ত্রী-সন্তানরা আহত হন।

সিলেটের বিভিন্ন উপজেলা ও পৌরসভাগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিলেটের ১৩টি উপজেলা এবং ৫টি পৌরসভার মধ্যে যারা আত্মগোপনে রয়েছেন তারা হলেন- সিলেট সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ও সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অধ্যক্ষ সুজাত আলী রফিক, বিশ্বনাথ পৌরসভার মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা মুহিবুর রহমান, ওসমানীনগর উপজেলা চেয়ারম্যান ও সিলেট জেলা যুবলীগের সভাপতি শামীম আহমদ (ভিপি), বালাগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনহার মিয়া, দক্ষিণ সুরমা উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. বদরুল ইসলাম, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক মো. মজির উদ্দিন, জৈন্তাপুর উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত আলী, কানাইঘাট উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক মোস্তাক আহমদ পলাশ, কানাইঘাট পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি লুৎফুর রহমান, গোলাপগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান ও সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মঞ্জুর কাদির শাফি চৌধুরী এলিম, গোলাপগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আমিনুর রহমান রাবেল, জকিগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি লোকমান উদ্দিন চৌধুরী। তারা সরকার পতনের পর থেকে আড়ালে চলে গেছেন। কিন্তু জকিগঞ্জ পৌরসভার নবনির্বাচিত মেয়র ফারুক আহমদ বুধবার পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব গ্রহণ করার পর থেকে অফিস করে যাচ্ছেন এবং জকিগঞ্জের নাগরিকদের সেবা প্রদান করছেন।

অন্যদিকে যারা এখনও উপজেলা ও পৌরসভায় নাগরিকদের সেবা প্রদান করে যাচ্ছেন তারা হলেন- ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আশফাকুল ইসলাম সাব্বির, গোয়াইনঘাট উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির বহিষ্কৃত কোষাধ্যক্ষ শাহ আলম স্বপন, বিয়ানীবাজার উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম পল্লব, বিয়ানীবাজার পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা ফারুকুল হক।