যদি আরেকটু সময় পেতাম...
মৃত্যু নামের ঘাতক কখন যে কোথায় কার জন্য ওত পেতে থাকে কেউ জানে না। এই যে ছবিতে যে জায়গাটি দেখা যাচ্ছে, এটি অনেকটা আমাদের বাড়ির আঙিনার মত। নাম লে স্ট্রিট। বাসা থেকে মাত্র মিনিট দশেকের দূরত্ব। প্রতিদিন এই পথ ধরে কাজে যাই, বাজারে যাই, বাচ্চাদেরকে নিয়ে এখানে সেখানে বেড়াতে যাই। কখনো হেঁটে, কখনো গাড়ীতে চড়ে। কিন্তু কখনোই এই রাস্তাটিকে এতটা অনিরাপদ মনে হয়নি। অথচ এখানেই গত ১৭ই মার্চ রাত বারোটার দিকে এক মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মারা যান কমিউনিটির প্রিয় মুখ, প্রতিভাবান ব্রিটিশ-বাংলাদেশী নাট্য ও চলচ্চিত্র পরিচালক জি এম ফুরুখ । মাত্র ছেচল্লিশ বছর বয়সে ঝরে গেল একটি তাজা প্রাণ। স্ত্রী ও ছোট ছোট তিন সন্তানকে রেখে কমিউনিটিকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে চিরবিদায় বিদায় নিলেন তিনি।
তাঁর মৃত্যু নিয়ে খুব বেশী তথ্য পাওয়া যায় না। বিবিসি ও স্থানীয় পত্রিকা ইলফোর্ড রেকর্ডার পুলিশের বরাত দিয়ে অল্প কিছু তথ্য জানিয়েছে। বলা হয়েছে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে রাত সোয়া বারোটার দিকে। যদিও তারা খবরে জি এম ফুরুখের নাম, পরিচয় কিছুই উল্লেখ করেননি। শুধু বলেছে, ‘ পথচারী’। কিন্তু ঘটনার বিবরণে বোঝা যায় এই পথচারীই আমাদের প্রিয় মানুষ, সাংস্কৃতিক জগতের প্রিয় সহকর্মী জি এম ফুরুখ। গণমাধ্যম দুটি আরও জানিয়েছে এই দুর্ঘটনার সাথে জড়িত সন্দেহে ২৯ বছর বয়সী একজন পুরুষ ও ২৮ বছর বয়সী একজন মহিলাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। একইসঙ্গে একটি রেঞ্জ রোভার গাড়ীও সনাক্ত করা হয়েছে। গাড়ীটি সনাক্ত করা হয়েছে স্থানীয় একটি গ্যারেজ থেকে।
ওই সময়টাতে ফুরুখ সেখানে কেন এসেছিলেন সঠিক জানা যায় না। পরিচিত কারো মতে তিনি একটি পিৎজা শপে ডেলিভারিম্যানের কাজ করতেন। খুব সম্ভবত কোথাও পিৎজা ডেলিভারি দিতে এসেছিলেন। আহারে জীবন! অন্য অনেকের মত কাজ শেষ করে নিশ্চয় সেদিন রাতে তাঁরও ঘরে ফেরার তাড়া ছিল। তাড়া ছিল স্ত্রী, সন্তানদের কাছে ফেরার। কিন্তু কখনো কী তিনি কল্পনা করতে পেরেছিলেন যে লে স্ট্রিটের এই জায়গাটিতেই নিভে যাবে তাঁর প্রাণ প্রদীপ! ওই রাতটিই হবে তাঁর জীবনের শেষ রাত!
অফিস থেকে ফেরার পথে আজ দুপুরে দুর্ঘটনাস্থলটিতে কিছু সময়ের জন্য থামলাম। না, কোথাও দুর্ঘটনার কোনো আলামত চোখে পড়ল না! রক্তের দাগ নেই, গাড়ীর পার্টস ভেঙ্গে পড়ে নেই, রাস্তাটি একেবারে পরিষ্কার। শুধু দুই পাশে দুটি হলুদ নোটিশ বোর্ড দাঁড় করিয়ে রাখা যেখানে পুলিশ উল্লেখ করেছে দুর্ঘটনার সংক্ষিপ্ত কিছু তথ্য।
তখন বেলা তিনটা। স্কুল ছুটির সময়। রাস্তার দুই পাশে দুটি স্কুল। একটি সেভেন কিংস হাই স্কুল, অন্যটি সেভেন কিংস প্রাইমারী স্কুল। পুরো এলাকাটি ছাত্র-ছাত্রী ও তাদের অভিভাবকদের পদভারে মুখরিত। বেশ কিছু সময় আমি নীরবে দাঁড়িয়ে শুধু ভাবছিলাম— আহা, এই যে শিক্ষার্থীদের কলকাকলি, এই যে অভিবভাবকদের ছুটে আসা তাদের সন্তানদেরকে বাড়ী নেয়ার জন্য, তারা কী জানেন এখানে গত ১৭ই মার্চ রাতে ঝরে গেছে একটি তাজা প্রাণ, চিরদিনের জন্য থেমে গেছে একটি জীবনের কলকাকলি! ছাত্র-ছাত্রীদের দিকে তাকিয়ে ফুরুখের ছোট ছোট তিন সন্তানের মনের অবস্থা চিন্তা করে বুকটা হু হু করে ওঠে!
ততক্ষণে সাড়ে তিনটা বেজে গেছে। আমাকেও ছুটতে হবে সামিরের স্কুলের দিকে। সেখানে সে অপেক্ষা করছে বাবার জন্য। ছুটির ঘণ্টা বাজতেই দৌড়ে এসে সামির বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। গালে চুমু খায়। ফুরুখও নিশ্চয় বেঁচে থাকলে আজ এভাবে আমার মতো তাঁর সন্তানের স্কুলে যেতেন তাকে বাড়ী নেয়ার জন্য। তাঁর সন্তানটিও নিশ্চয় সামিরের মত অপেক্ষায় থাকত বাবার জন্য। বাবাকে দেখলে ঝাঁপিয়ে পড়ত বাবার বুকে। আহা জীবন! কী নির্মম এই বাস্তবতা! কী নিষ্ঠুর এই দুর্ঘটনা! কী হৃদয়বিদারক এই মৃত্যু! হে জীবন, কেন তুমি মানুষেরে করো এত বঞ্চনা!
অল্প সময়ে বেশ নাম করেছেন জি এম ফুরুখ। লণ্ডনে বাংলা টিভি ও চ্যানেল আইসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে সুনামের সঙ্গ কাজ করেছেন। বাংলাদেশী কমিউনিটিতে তিনি সহকর্মীদের ভালবাসা অর্জন করেছেন তাঁর সৃজনশীল কাজ দিয়ে, তাঁর মধুর ব্যবহার দিয়ে। তাঁর নির্মিত সিনেমাটির নামের কথা ভাবলে খুবই অবাক হতে হয়। আহা কী নাম— ‘ যদি আরেকটু সময় পেতাম’। নায়ক ফেরদৌস এতে অভিনয় করেছেন। যতদূর জানি সিনেমাটি এখন মুক্তির অপেক্ষায়। কিন্তু কী আশ্চর্য ফুরুখের জীবনের সাথে কীভাবে মিলে গেল সিনেমাটির নাম! তবে কী জীবন এভাবে নানান ইশারায় মানুষকে জানিয়ে দেয় মৃত্যুর পয়গাম! অল্প অল্প করে জানিয়ে দেয় প্রস্থানের ইঙ্গিত! মৃত্যু নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের সেই বিখ্যাত গানের মত— ‘সে আমারে ঠারে ঠারে ইশারায় কয়, এই চাঁন্দের রাইতে তোমার হইছে গো সময়...’! ‘যদি আরেকটু সময় পেতাম’ নামটি কী তবে সেরকমই একটি ঠার, সেরকমই একটি ইশারা!